ঢাকা; অনেকদিন ধরে শরীরটা ভালো নেই। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু অতীত জীবনের আলোচনা উঠতেই তেজোদীপ্ত, উজ্জ্বল। সেই চিরচেনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নাম। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনেই চমক সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হন। সেই শুরু।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে কেবলই এগিয়ে চলা। আটবার নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড আর কারইবা আছে? সংসদে ঝড় তুলেছেন বারবার। অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন এক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবেই। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম উচ্চরিত হবেই। বন্ধু আর শত্রু সবার সঙ্গে মাতেন তর্কে। কখনো কখনো জন্ম দেন বিতর্কের। মাঝেসাজে হোঁচট খেয়েছেন। তবে, রাজনীতির কঠিনতর ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করেছেন নিজস্ব ক্যারিশমায়। কথা বলারও নিজস্ব একটি ধরন আছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। তির্যক, স্পষ্ট। কখনোবা কিছুটা নির্দয়। সমালোচনা করেন সরকার ও দলেরও। নিজেও হন সমালোচিত। বন্ধু ও প্রতিপক্ষের দ্বারা। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে সমীহ তিনি আদায় করেছেন ঠিকই।
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আনোয়ারপাড়া গ্রামে জন্ম নেয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সত্তরের নির্বাচনের পর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে একতা পার্টি থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে করেছেন কারাবরণ। ১৯৮৬ সালে আবারও নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদে যান। পরে গণতন্ত্রী পার্টি ত্যাগ করে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। সপ্তম সংসদে হবিগঞ্জ-২ আসন থেকে উপনির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০০১ সালে সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে আবারও বিজয়ী হন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের পর আবারও সংসদে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক। ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার স্প্রিন্টার এখনও শরীরে বহন করে চলছেন তিনি।
ষাটের দশকে বাম রাজনীতির মাধ্যমে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের সক্রিয় রাজনীতির শুরু। আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী উত্তাল আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজপথ কাঁপিয়েছেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয় তার। এগার দফা, ছয় দফা আন্দোলন, সত্তরে ন্যাশনাল আসেম্বলির সদস্য, সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি, এরপর একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি হয়ে পরে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ। আপাদমস্তক রাজনীতিক হিসেবে সেক্যুলার কিংবা অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, চেতনা ধারণ করেছেন সবসময়ই। করেন এখনও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। তার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণাকে তখনও লালন করতেন, এখনও করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল তার মধ্যে। তার ভাষায়, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ধারণাই করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু কি ছিলেন, আর কি করতে পারেন। ৬৬’র ছয়দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাই তার প্রমাণ।
জরুরি জমানায় ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের আমলে তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা তখন আলোচনায়। তখন কথিত সংস্কারের নামে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো ঝানু রাজনীতিবিদও ভুলের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন বলে আলোচনা রয়েছে। অনেকের মতেই যা ছিল তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বড় ভুল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মন্ত্রীত্ব না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী হয়েও কখনো মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা হয়নি তার। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তার সমসাময়িকদের দুএকজনের কপাল খুললেও কপাল খোলেনি তার। পরে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বহুদিনের লালিত সেই মন্ত্রীত্বের স্বাদ গ্রহণ করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাকে দেওয়া হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন, রাজনীতির মাঠের অভিজ্ঞ সৈনিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সফল হবেন মন্ত্রী হিসেবেও। কিন্তু বিধিবাম। ক’মাস পরই ‘বিজিবি গেট’ কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। প্রায় মধ্যরাতে বিজিবি সদর দপ্তরের সামনের গেটে তার এপিএস ও রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা ধরা পড়েন টাকার বস্তাসহ। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই পদত্যাগ করেন তিনি। তবে, শেষ পর্যন্ত দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয় তাকে। তার ভাষায়, সারাজীবন প্রতিপক্ষের দিকে তিনি যে তীর ছুড়েছেন, সেই তীরে তিনিই বিদ্ধ হলেন।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিবেচনা করেছেন বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবীদের ‘যুদ্ধ’ হিসেবে। মানবজমিনকে তিনি বলেন, বিশ্বের যেখানে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে প্রতিবিপ্লবও হয়েছে। প্রতিবিপ্লবী শক্তির সঙ্গে অসামাপ্ত যুদ্ধই এখন চলছে। এই যুদ্ধ আরও চলবে। এখানে থামার কিছুই নেই। হয় একজন থেমে যাবে, নয়তো বিপ্লবের যে মূল কথা ৭২’র সংবিধান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সেটি বজায় থাকবে। তবে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রতিবিপ্লবীরা ধ্বংস হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, পঁচাত্তরেও ওরা সক্রিয় ছিল। আমরা যখন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলাম, তখন আমাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। আমরা হয়তো বুঝতে পারিনি যে, এরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন পঁচাত্তরে ভেঙে গিয়েছিল। এখন তাদের স্বপ্ন ভাঙা শুরু হবে। নতুন রাজনীতি ‘গ্রো’ করবে। পৃথিবীর মাত্র কয়েকটা দেশ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এরমধ্যে আমরা অন্যতম। তাই বাংলাদেশে থাকতে হলে এই দেশকে মেনেই থাকতে হবে।