বিদ্যুৎ খাতে গত ছয়-সাত বছরে যে উন্নতি হয়েছে, বর্তমানে ঢাকার বাইরে দেশের কোথাও তার কোনো প্রতিফলন নেই। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, ঢাকা ছাড়া ছোট-বড় প্রায় সব শহর-নগরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো নয়। গ্রামে ও অনেক উপজেলা শহরে দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। শহর-নগরে চার থেকে ছয়বার পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশও হচ্ছে।
বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, লোডশেডিংয়ে পড়াশোনা, চিকিৎসা, কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রাজশাহীতে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নওগাঁয় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকেরা চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। জামালপুরে বিদ্যুতের চাহিদা ৪৭ মেগাওয়াট। মাস তিনেক ধরে সরবরাহ করা হচ্ছে ১৮-২০ মেগাওয়াট। বগুড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলে। নীলফামারীর মানুষ বিদ্যুতের যাওয়া-আসায় অতিষ্ঠ। খাগড়াছড়িতে দৈনিক ১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। টেকনাফে লোডশেডিং হয় ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা। মেহেরপুর, ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলেও লোডশেডিং চলে দফায় দফায়। বরিশালের অনেক এলাকায় টানা দু–তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকাটা একটা বড় ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সাতক্ষীরা সদরে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হলেও এর বাইরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বেশ নাজুক।
ঢাকাও একেবারে সমস্যামুক্ত নয়। গত শনিবার বিকেলে ঢাকার নিমতলীতে এশিয়াটিক সোসাইটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠান চলাকালে লোডশেডিংয়ের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে ও মধ্যভাগে দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী প্রধান অতিথি ছিলেন। একই দিন জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না। কয়েক দিন আগে বঙ্গভবনেও দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে।
ঢাকার কোনো এলাকায় যখনই বিদ্যুৎ থাকে না, তখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কারণ জানতে চাইলে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কথা শোনা যায়। আর শোনা যায়, সঞ্চালন ও বিতরণ-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই যখন-তখন সরবরাহ বন্ধ করে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সঞ্চালন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথাই বলেছেন। এ ছাড়া জ্বালানির অভাবে, বিশেষ করে গ্যাস-স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করতে হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সঞ্চালন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে তিন-চার বছর লাগবে বলে প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তবে জ্বালানির ঘাটতি কত দিনে পূরণ হতে পারে, সে সম্পর্কে তিনি নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না।
সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুতের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের নতুন লাইন করা হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) প্রতি মাসে কয়েক লাখ, কখনো কখনো মাসে পাঁচ লাখ পর্যন্ত নতুন সংযোগ দিচ্ছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে কমই। গ্রীষ্মকাল, সেচ মৌসুম ও অনাবৃষ্টির সময়ের কথা বাদ দিলেও গ্রামাঞ্চল এখনো বিদ্যুৎহীন থাকছে।
গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) মোট ৩০ লাখ নতুন গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল আরইবি। বাস্তবে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ। এর ফলে এই অর্থবছরে আরইবির বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে এক হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। বর্তমানে আরইবির আওতাধীন এলাকায় (মূলত গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহর) প্রতিদিন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ চার হাজার মেগাওয়াটও পাওয়া যাচ্ছে খুব কম দিন।
এ বছরের গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে আরইবির আওতাধীন এলাকায় দুই হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি লোডশেডিংয়ের রেকর্ড রয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল আরইবির এলাকায় চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৮০৭ মেগাওয়াট। সরবরাহ করা হয়েছে ২ হাজার ৭৬১ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪৬ মেগাওয়াট। গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুম চলে গেলেও আরইবির এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসে আরইবির এলাকায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং রেকর্ড করা হয়েছে ১ হাজার ২৭৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের উৎপাদন-ঘাটতির কারণে সরবরাহ করতে না পারা এই লোডশেডিংয়ের কারণ। এ ছাড়া সঞ্চালন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিদিন শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
জানতে চাইলে আরইবির নির্ভরযোগ্য সূত্র কেজানায়, আরইবির ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কর্মসূচি নিয়েছে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আরইবি নতুন নতুন লাইন করছে। সংযোগ দিচ্ছে। বিতরণ-ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন করছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি আরইবির এই কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না বলে মনে হয়।
আরইবির সূত্র জানায়, তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম বিতরণ-ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে আরইবির ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রের সংখ্যা সাত শতাধিক। ১১ কেভি বিতরণ লাইনের (ফিডার) সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি না থাকলে গ্রামের মানুষের বিদ্যুৎ পেতে এখন আর সমস্যা নেই। তবে ঝড়-ঝঞ্ঝার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। লাইনের ওপর গাছপালা পড়ে প্রায়ই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়। এর প্রতিকার পাওয়ার মতো কোনো উপায় আপাতত নেই। এ ছাড়া নতুন নতুন সংযোগ দেওয়া অব্যাহত থাকায় সব সময়ই কিছু কিছু ট্রান্সফরমার, উপকেন্দ্র ও বিতরণ লাইন ভারাক্রান্ত (ওভারলোডেড) হয়ে পড়ে। সেগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও সব সময়ই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
আরইবি ছাড়াও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ওজোপাডিকো) এলাকায়ও লোডশেডিং হচ্ছে। সঞ্চালন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে হচ্ছে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটও।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা পূরণ করতে হলে এখন প্রতিবছর গড়ে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট করে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু সরকারের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো স্থাপনের প্রক্রিয়া পিছিয়ে পড়ায় ওই লক্ষ্য অর্জনও বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এ কারণে সরকার আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আরও এক হাজার মেগাওয়াটের জন্য দরপত্র গ্রহণ করে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়-বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ছাড়া সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। আর যেহেতু গ্যাস-সংকট আছে, সেহেতু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লাভিত্তিক হওয়াই সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে। তা না হলে জ্বালানি তেল বা এলএনজি ব্যবহার করে সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিদ্যুতের নতুন নতুন সংযোগ যখন দেওয়া হচ্ছে, তখন সঞ্চালন ও বিতরণ-ব্যবস্থার উন্নয়নও অব্যাহতভাবে করে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।