বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্রের জম্পেশ এক বিতর্ক হয়ে গেল। মুহুর্মূহু আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণে একে অন্যকে ঘায়েল করলেন। ডায়াসে তখন মুখোমুখি ডেমোক্রেট হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এ দু’প্রার্থীর ‘ফায়ার্স’ বা অগ্নিঝরা বিতর্ক প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। এতে স্বভাবসুলভভাবে হিলারি ক্লিনটনকে আক্রমণ করলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বললেন, হিলারি ক্লিনটনের ‘স্টামিনা’ বা টিকে থাকার মতো শক্তি নেই। তার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ‘ব্যাড এক্সপেরিয়েন্স’। ব্যক্তিগত এ আক্রমণের উচিত জবাব দিয়ে দিলেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি বললেন, ডনাল্ড নারীদের সম্মান দিতে জানেন না। তিনি নারীদেরকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেন। এমন ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার ইন চিফ হওয়ার ‘টেম্পারামেন্ট’ বা মানসিক প্রস্তুতি থাকে না। মুলত কর্মসংস্থান, ট্যাক্স, আয়কর রিটার্ন, ইমেইল কেলেঙ্কারি, পররাষ্ট্র নীতি সহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে গতকাল (বাংলাদেশের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৭টায়) নিউ ইয়র্কের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে এ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশনে সরাসরি উপভোগ করেন এ বিতর্ক। এতে হিলারি ক্লিনটন সারাক্ষণই নিজের ধৈর্য্যরে, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প যখন বক্তব্য রাখেন তখন তার মাঝে তিনি ফোঁড়ন কেটেছেন খুব সামান্যই। কিন্তু হিলারি যখন বক্তব্য রেখেছেন তখন প্রতিবারই বার বার তার বক্তব্যের মধ্যে তীর্যক বাক্য ছুড়ে দিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ইরাক আগ্রাসন, মধ্যপ্রাচ্য নীতির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আইসিস বা আইএস সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তা অস্বীকার করেন হিলারি। তিনি বলেন, ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং সেই আগ্রাসনে ডনাল্ড ট্রাম্প সমর্থন দিয়েছিলেন। এ সময় ট্রাম্প ‘রঙ’ বা মিথ্যা বলে বিষয়টি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। হিলারি ক্লিনটন জোর দিয়ে বলেন, ট্রাম্প যে ইরাক, লিবিয়া যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিলেন সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে। মডারেটর লেস্টার হল্ট এক পর্যায়ে ট্রাম্পের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে মারেন। তিনি জানতে চানÑ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করেছেন। আপনি কি এটা সমর্থন করেন? এ প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর না দেন নি ট্রাম্প। তিনি বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে বলতে থাকেন আইসিস সৃষ্টি করেছেন ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন। এক পর্যায়ে তিনি ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিকে যেকোনো দেশের সঙ্গে সবচেয়ে বাজে চুক্তি বলে অভিহিত করেন। এক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটন বলেন, পারমাণবিক চুক্তি হয়েছে। ইরানের ওপর থেকে অনেকটা অবরোধ প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জলসীমায় মার্কিন সেনাদের পাশাপাশি ইরানি সেনারা টহল দিচ্ছে। একটি গুলিও সেখানে ফোটে নি। কিন্তু ট্রাম্পের অধীনে এমনটা হতো না। সেখানে এতদিনে যুদ্ধ বেধে যেত। কিন্তু ট্রাম্প তার বক্তব্যে ইরানের সঙ্গে এই সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। হিলারি ক্লিনটন জোর দিয়ে বলেন, আমি গণতন্ত্রকে সমর্থন করি। যুক্তরাষ্ট্রের এ নির্বাচন মার্কিনিদের জন্য। এটা আমার বা আমাদের জন্য নির্বাচন নয়। শুরুতে মডারেটর প্রশ্ন রাখেন যে, কর্মীদের পকেটে অর্থ যাবে এমন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আপনাকে কেন বেশি পছন্দ করে নিতে হবে? জবাবে হিলারি ক্লিনটন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি অধিক কর্মসংস্থানের কথা বলেন। মধ্য আয়ের মানুষের জন্য তিনি বেশি কাজ করার কথা বলেন। ট্রাম্প তার বক্তব্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ট্যাক্স কমিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, অনেক কোম্পানি দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। তাদেরকে থামাতে হবে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যাবে। সে জন্য কমিয়ে দেয়া হবে ট্যাক্স। কিন্তু এতদিনে কেন সেটা হয় নি? এ বিষয়ে জানতে চান ট্রাম্প। এ সময় তিনি বলেন, এটা কি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ত্রুটি? তার তীর্যক প্রশ্নের জবাবে হিলারি বলে ওঠেনÑ ওয়াও, ওকে। এ সময় তিনি আলতো করে কাঁধ ঝাঁকান। বিতর্কে উঠে আসে মার্কিন সাইবার ঝুঁকির প্রসঙ্গ। এ সময় রাশিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগ উত্থাপন করেন হিলারি। তিনি বলতে চেষ্টা করেন যে, এসব সাইবার হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার, সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি, এমনকি হিলারির ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে হ্যাকাররা। তার সঙ্গে ডনাল্ড ট্রাম্পের সম্পৃক্ততার খবর প্রকাশিত হয়েছে। যে রাশিয়া মার্কিনি মূল্যবোধের ঘোর বিরোধী তার সঙ্গে ট্রাম্পের হাত মেলানোর অভিযোগ করেন হিলারি। এক পর্যায়ে মডারেটর ডনাল্ট ট্রাম্পের কাছে জানতে চানÑ আপনার পাশে দাঁড়ানো সুন্দরী, স্মার্ট প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। তার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি? জবাবে ডনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তার তো কোন স্টামিনাই নেই। বাণিজ্য, সমঝোতা, সক্ষমতা কিছুই নেই তার। তার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু সেগুলো সব বাজে অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন শুনে জ্বলে ওঠেন হিলারি। তিনি বলেন, ট্রাম্প নারীদের সম্মান দিতে জানেন না। তিনি নারীদের দেখেন পিগস, ডগস হিসেবে। তিনি আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী দৃষ্টিতে তাকান। তিনি তাদেরকে সম্মান দিতে জানেন না। এমনই এক বিতর্ক নিয়ে এখন মার্কিন মুলুক সহ সারাবিশ্বে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কারণ, এ বিতর্কের পর নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে। কে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যান, আর কে পিছিয়ে পড়েনÑ তা জানতে আমাদেরকে আরও কিছুটা ধৈর্য্য ধরতে হবে।