ঢাকা; যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা বলে গত ডিসেম্বরে স্ত্রী শায়লা আক্তার ও নবজাতককে ঢাকার কলাবাগানে শ্বশুরবাড়িতে রেখে উধাও হন মো. বাশারুজ্জামান। পাঁচ মাস পর হঠাৎ এসে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে যান। তারপর থেকে নিখোঁজ। এর চার মাস পর আজিমপুরে পুলিশের অভিযান হলে অভিভাবকেরা জানতে পারেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।
১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার তিন নারীর একজন হলেন বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আক্তার। অভিযানে আহত হয়ে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ওই আস্তানা থেকে আটক নিহত জঙ্গি তানভির কাদরির স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ও নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের স্ত্রী শারমিন আক্তার। পুলিশ বলছে, এসব নারী ও তাঁদের স্বামীরা সবাই নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। তবে বাশারুজ্জামান ও মারজানের হদিস এখনো জানা যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার তিন নারীকে তাঁদের স্বামীরাই উগ্র মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বলেছেন যে ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াই করছেন তাঁরা। স্বামীরাও ঠিক পথে আছেন বলে তাঁরা এখনো মনে করেন।
শায়লা আক্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর মা শিরিন আক্তার গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘শায়লা আমার একমাত্র মেয়ে। গত বছরের নভেম্বরে নাতনির জন্মের পর আমি মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম। অফিসের কাজে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে বলে ডিসেম্বরে জামাতা বাশারুজ্জামান চলে গেল। এরপর পাঁচ মাস আর কোনো খবর নাই। মেয়ে (শায়লা) শুধু কাঁদে। মে মাসের ৫ তারিখ হঠাৎ আসল বাশার। এসেই মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে চলে গেল। আর কোনো খোঁজ পাইনি। সর্বশেষ তো এখন দেখতেই পাচ্ছেন।’ জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা বাশারুজ্জামান-শায়লা দম্পতির ১০ মাসের সন্তান এখন নানির হেফাজতে। তিনি বলেন, ‘এই বাচ্চা কেমনে থাকে? মা পুলিশের কাছে, বাবা নিখোঁজ। দুধের বাচ্চা সামলানো খুব কষ্ট।’
শায়লার স্বজনেরা জানান, বছর দুয়েক আগে পারিবারিকভাবে বাশারুজ্জামানের সঙ্গে শায়লা আক্তারের বিয়ে হয়। শায়লা ইডেন কলেজে দর্শনে স্নাতক পাস। বাশারুজ্জামান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বনানীর একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। শায়লার বাবা আবুল হোসেন আল-আমিন মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। ওই মসজিদের একজন মুসল্লির মধ্যস্থতায় শায়লা-বাশারুজ্জামানের বিয়ে হয়।
পরিবারের দাবি, বিয়ের পর তারা শায়লা বা বাশারের আচরণে অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। তবে বাশারুজ্জামান পাঁচ মাস যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থাকার পর হঠাৎ এসে শায়লা ও নাতনিকে নিয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
পুলিশ এখন বলছে, বাশারুজ্জামান নিউ জেএমবির প্রভাবশালী নেতা। শুধু গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার জন্য দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে ১৪ লাখ টাকা এই বাশারের কাছেই পাঠানো হয়েছিল। সংগঠনে তিনি চকলেট নামে পরিচিত।
নিখোঁজ হওয়ার পর রাজশাহীতে বাশারুজ্জামানের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে শায়লার মা শিরিন আক্তার বলেন, বাশার তাঁর পরিবারকেও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। গত মে মাসের পর যখন ওদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আবার খোঁজ নিলে বাশারের স্বজনেরা কিছু জানাতে পারেননি। পরে জুলাই মাসে টেলিভিশনে নিখোঁজদের সঙ্গে বাশারুজ্জামানের ছবি দেখালে শায়লার বাবা আবুল হোসেন কলাবাগান থানায় নিখোঁজ ডায়েরি (জিডি) করেন। শিরিন আক্তার বলছিলেন, ‘আমার কথা হলো, বাশারুজ্জামানের জঙ্গি হতে ইচ্ছে হয়েছে, সে হোক, আমার মেয়েটাকে কেন বিপদে ফেলল?’
রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের বড় মেয়েকে (৭) আজিমপুরের ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করে নানা-নানির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটির নানি জোহরা খাতুন , ‘ও আমাদের বলেছে, “আম্মু আমাকে বলেছে দুজনকে নিয়ে চলাফেরা করতে কষ্ট হয়, আমি যেন আন্টির কাছে (আজিমপুরে) কিছুদিন থাকি। পরে এসে আমাকে নিয়ে যাবে।”’
নাতনির বরাত দিয়ে জোহরা খাতুন বলেন, যে রাতে অভিযান হয়, ওই দিন মেজর (অব.) জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার আজিমপুরের ওই বাসায় এসে মেয়েকে দেখে গিয়েছিলেন।
শিশুটির আরেক স্বজন বলেন, আজিমপুরে অভিযানের চার দিন আগে জেবুন্নাহার তাঁর বড় মেয়েকে তানভির কাদেরির স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমার কাছে রেখে যান। ওই স্বজন বলেন, শিশুটি এখন প্রায়ই মাঝরাতে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বলে, ‘আম্মু তুমি কোথায়, তুমি আস।’
পুলিশ বলছে, জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহারের (শীলা) খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে ছোট বাচ্চাটিও রয়েছে।
আজিমপুরের অভিযানে নিহত তানভির কাদরির কিশোর ছেলে তিন দিনের রিমান্ড শেষে এখন কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। তানভিরের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর মাথার পেছনে গভীর ক্ষত আছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের সাবেক কর্মকর্তা আবেদাতুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস।
সেভ দ্য চিলড্রেনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, আবেদাতুল ‘আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ওই প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত ছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিলে চাকরি ছেড়ে দেন। তখন সহকর্মীকে বলেছিলেন, তিনি সপরিবারে মালয়েশিয়ায় চলে যাচ্ছেন।
মারজানের স্ত্রী শারমিন আক্তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারানোর পর থেকে মারজানের বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানেই ছিলেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে মারজানের সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিখোঁজ ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক এলাহী চৌধুরী বলেন, যেসব নারী ও শিশু উগ্র মৌলবাদে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের এই মতাদর্শ থেকে বের করে আনার (ডির্যারডিক্যালাইজেশন) ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের সদস্য, সামাজিক মনোবিজ্ঞানী, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তাঁদের সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। তবে যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের শাস্তি পেতে হবে।