ঢাকা; ‘আন্তর্জাতিক মানসম্মত এবং সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স (কারখানাবিধি মেনে চলা) প্রতিষ্ঠান’ দাবি করা হলেও টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের ভবনে যথাযথ সিঁড়িই ছিল না। তারা শ্রমবিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেই চলছিল। তারা শ্রমিকদের নিয়োগপত্রও দেয়নি। ছিল না শ্রমিক-কর্মকর্তাদের ভবিষ্য-তহবিল, গ্রাচ্যুইটি বা গোষ্ঠীবিমার মতো কোনো ব্যবস্থা।
ভয়ংকর বিস্ফোরণ ও ধ্বংসের পর দাঁড়িয়ে থাকা টাম্পাকোর একটি পাঁচতলা ভবন সাক্ষ্য দিচ্ছে, তার ভেতরে কোনো সিঁড়িই ছিল না। ভবনের বাইরে দিয়ে ইস্পাতের কাঠামো দিয়ে একটি সিঁড়ি বানানো হয়েছিল। দুটি লিফটের অবস্থানও ছিল ভবনের বাইরে। বিস্ফোরণে এ দুটি লিফটই উড়ে যায়। আর দালানের বাইরে অস্থায়ী দোলনার মতো ঝুলছে ইস্পাতের সিঁড়িটি। দুটি লিফটে সিগারেটের ফয়েল তৈরির আমদানি করা উপকরণ তোলা হতো।
সিঁড়িবিহীন ভবনটিতেই বেনসন অ্যান্ড হেজেস, গোল্ডলিফ, ডার্বি, হলিউড নামের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের সিগারেটের ফয়েল তৈরির উপকরণ থাকত। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন নিশ্চিত করেন, ইমারত আইনমতে সিঁড়িবিহীন দালান তৈরির কোনো বৈধতা থাকতে পারে না।
১০ সেপ্টেম্বর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পর ভয়াবহ আগুন লেগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় টাম্পাকোর দুটি ভবন। এতে গতকাল শনিবার পর্যন্ত মারা যান ৩৬ জন। ২০০৬ সালে টাম্পাকোর শ্রমিক ছিল ১৩৯। টাম্পাকোর মালিক ১০ সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধিকে বলেছেন, তাঁর মোট শ্রমিকের সংখ্যা ৪৫০। তবে দুর্ঘটনার মুহূর্তে ‘কমবেশি’ ৭০-৭৫ জন কর্মরত ছিলেন।
সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের প্রধান হিসেবে কর্মরত লে. কর্নেল আজম টাম্পাকো দুর্ঘটনাকে রানা প্লাজার চেয়ে তিন গুণ বেশি ভয়াবহ মনে করেন। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। এ ঘটনা বিশ্বে হইচই ফেলে দেয়। কিন্তু অত্যন্ত দামি সিগারেটের সোনালি ফয়েল কিংবা ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় কনডম লেটেক্সের ফয়েল তৈরির এই কারখানায় মৃতের সংখ্যা কম হওয়ায় এবার বিশ্ব রক্তের দাগ দেখছে না। অবশ্য শুধু বহুজাতিক কোম্পানিই নয়, বাংলাদেশ সরকারও টাম্পাকোর অন্যতম বড় গ্রাহক।
জানতে চাইলে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি), যারা বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের বাজারে টাম্পাকোর শ্রমিকদের তৈরি করা ফয়েলসে মোড়ানো নামীদামি ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি করছে, তারা টাম্পাকোর পক্ষে প্রথম আলোর কাছে সাফাই বক্তব্য দিয়েছে। তারা বলেছে, ২০১৫ পর্যন্ত টাম্পাকো ঠিকঠাক চলছিল।
সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) একটি পরিদর্শন দল এ বছরের গোড়ায় ‘টাম্পাকোর অভ্যন্তরীণ বিলাসবহুল সাজসজ্জা দেখে মুগ্ধ’ হয়েছিল। তবে লন্ডনভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থা বিএটি, যার ১৩ শতাংশের শেয়ার বাংলাদেশ সরকারের, তারা যেভাবে টাম্পাকোর কারখানাবিধি মেনে চলার সপক্ষে বক্তব্য দিয়েছে, তা প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাকচ করে দিয়েছেন গাজীপুর-টঙ্গী থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সাংসদ মো. জাহিদ আহসান রাসেল। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এই সাংসদ ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর টঙ্গীর বাসভবনে বিস্ফোরণ-পূর্ববর্তী টাম্পাকোর অবস্থাকে ‘মৃত্যুকূপের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তবে চেষ্টা করেও এ বিষয়ে টাম্পাকোর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরাসরি যোগাযোগ করতে না পেরে টাম্পাকোর ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তার কোনো উত্তর মেলেনি। টাম্পাকোর অদূরে লিলিপুট মোড়ে একই মালিকানাধীন টাম্পাকো টোব্যাকোর কার্যালয়ে গিয়েও প্রহরী ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি।
টাম্পাকো দুর্ঘটনায় নিহত ৩৬ জনের মধ্যে ১ জন রিকশাচালক, ২ জন পথচারী এবং পাশের বাড়ির একটি শিশুও রয়েছে। নিখোঁজ ১১ শ্রমিকের স্বজনেরা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আছে ছয়টি লাশ। গতকাল উদ্ধারকর্মীরা একজনের কঙ্কাল পেয়েছেন। অন্তত তিনটি পৃথক সরকারি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। বিস্ফোরণের কারণ বয়লার বা গ্যাস নয়, ‘সম্ভবত রাসায়নিক’—এ পর্যন্ত এটুকুই জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাহেনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগে তাঁরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি চিঠি পেয়েছেন। সেখানে উচ্চপর্যায়ের আন্তমন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কথা বলা আছে।
১৯৭৮ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জের সৈয়দ মকবুল হোসেন (লেচু মিয়া) টাম্পাকো ফয়েলস শুরু করেন। সৈয়দ মকবুল ১৯৭৫ সালে সরকারের উপসচিবের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে শিল্পোদ্যোক্তা হন। ১৯৮৬ ও ২০০১ সালে তিনি স্বতন্ত্র সাংসদ হন। তবে তিনি বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত।
১৯ ও ২২ সেপ্টেম্বর দুই দিন সরেজমিন পরিদর্শন ও উপস্থিত ভুক্তভোগী শ্রমিক পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাম্পাকোর পক্ষ থেকে কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেননি। যদিও শ্রমিকদের একাংশ মালিকের বিরুদ্ধে হওয়া ‘মিথ্যা’ মামলা তুলে নিতে পুলিশের উপস্থিতিতে মানববন্ধন করেছেন। সাধারণ শ্রমিকেরা যাঁদের মালিকের লোক বলে জানতেন, তাঁরা কেউ তাঁদের ফোন ধরছেন না। বেশির ভাগ শ্রমিকেরই জানা নেই, মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাসফল একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্যের অন্তত একটি অতি সংবেদনশীল উপকরণের নির্মাতা হিসেবে তাঁদেরও একটা মর্যাদা ছিল। কিন্তু তাঁরা কেবলই চোখ-কান বুজে নীরবে কাজ করেছেন। কারণ, তাঁরা বেতন ও উৎসব বোনাস নিয়মিত পেতেন।
একটি বেআইনি প্রতিষ্ঠান
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, নারী শ্রমিক-বর্জিত টাম্পাকো কখনোই শ্রমিকবহুল প্রতিষ্ঠান ছিল না। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকেরা মাসের ১ তারিখে বেতন পেতেন। কিন্তু সর্বশেষ ৩৭০ জনের বেতন যায় ব্যাংকে, যা পরিমাণে ছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা। টাম্পাকো যেভাবে বিএটির মতো বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করেছে, সেই তুলনায় শ্রমিকদের সুবিধা দেয়নি। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রমিকের বেতন ছিল ৯ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। ব্যাংকের রেকর্ড অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি বেতন ছিল ৭৫ হাজার টাকা।
২০১৫ সালের শ্রমবিধির ১৯ ধারায় আছে, প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগ ও পরিচয়পত্র দিতে হবে। কিন্তু অন্তত ২৫ জন শ্রমিক প্রতিবেদককে বলেছেন, তাঁদের কারও কোনো নিয়োগপত্র নেই। কারও কখনো ছিল বলেও তাঁদের জানা নেই। টাম্পাকো শ্রমিকদের শুধু ছবি-সংবলিত পরিচয়পত্র দিয়েছে। কিন্তু তাতে কার কী পদবি, তারও উল্লেখ নেই।
শ্রম আইনের ২০ ধারামতে, প্রত্যেকের জন্য শক্ত মলাটসহ টেকসই কাগজের ১৬টি মুদ্রিত পৃষ্ঠা-সংবলিত সার্ভিস বই থাকবে। কিন্তু টাম্পাকো শ্রমিকদের তা নেই। ২০০৫ সালের আগে ভবিষ্য-তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) চালু ছিল। কিন্তু তা বাতিলের পরে আর চালু করা হয়নি। সে কারণে দুই মাসের ওভারটাইমের মজুরি ছাড়া এখন মালিকের কাছে কারও কোনো পাওনা নেই। অথচ ২৩৭ ধারা অনুযায়ী ভবিষ্য-তহবিল এবং সে জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠনে মালিক বাধ্য।
শ্রমবিধির ৫৪ ধারা বলেছে, কোনো শ্রমিকের কর্মকক্ষ থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে তাঁর বহির্গমন পথ থাকবে। কোনো কক্ষে ২০ জন থাকলে সেখানে দুটি বহির্গমন পথ থাকবে। ভবনের প্রতিটি সিঁড়ি মজবুত ‘হ্যান্ডরেইল’যুক্ত হবে এবং সিঁড়ি ও রেইল তাপ অপরিবাহী এবং তা অগ্নিপ্রতিরোধক পদার্থ দ্বারা নির্মাণ করতে হবে। ছয়তলা ভবনে অন্তত সোয়া মিটার প্রশস্ত অমসৃণ সিঁড়ি থাকবে। কিন্তু এসবের কিছুই ছিল না টাম্পাকো কারখানায়।
তাপমাত্রা ও ওরস্যালাইন
শ্রমবিধির ৪৫ ও ৫২ ধারা বলছে, প্রতিটি কর্মকক্ষের তাপমাত্রা সহনীয় থাকবে। এতে নির্মল বায়ুপ্রবাহের জন্য পর্যাপ্ত বিপরীতমুখী জানালা থাকবে। ভেন্টিলেটর না থাকলে এক্সজস্ট ফ্যান থাকবে। কিন্তু শ্রমিকেরা বলেছেন, কোনো কোনো কর্মকক্ষ, বিশেষ করে নিচতলা তাপমাত্রা সহনীয় ছিল না। গরম এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে শ্রমিকেরা এ নিয়ে দেনদরবার করেছেন। এবং সে জন্য তাঁদের নিয়মিত ওরস্যালাইন পান করতে দেওয়া হতো। শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গাজীপুরের সাংসদ ও জেলা প্রশাসক দুজনই প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সমগ্র টাম্পাকো চত্বরে শ্রমিকদের বাইরে বেরোনোর একটি মাত্র পথ ছিল।’
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কারখানায় যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সেই আশঙ্কা তাঁদের ছিল। দুর্ঘটনার কয়েক দিন আগেও কারখানার অসহনীয় গরম ও পরিবেশ নিয়ে মালিকের জামাতা ও ডিএমডি সামির সঙ্গে শ্রমিকেরা কথা বলেছিলেন। কেউ কেউ চাকরি ছেড়েছেন।
‘নিচতলার প্রতিটি জানালা নেট দিয়ে আটকানো থাকত। যাতে কোনো মশা বা পোকামাকড় ঢুকতে না পারে। ফ্যান ছিল। কিন্তু তা গরম কমাত না।’ এই মন্তব্য শ্রমিক সাইফুর রহমানের। ২০০৬ সালের ১ মার্চ তিনি তাঁর চাচাতো ভাই মাসুমকে নিয়ে টাম্পাকোয় চাকরি নিয়েছিলেন। এই দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ রয়েছেন মাসুম। মাসুমের স্ত্রী রূপালী পাঁচ বছরের কন্যাসন্তান নিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থলের সামনে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুমের ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে তাঁর মন্তব্য, ‘আমি আমার স্বামীর লাশ চাই।’ শিশুটির বুকে ঝোলানো ছিল বাবার সঙ্গে তোলা তারই একটি রঙিন আলোকচিত্র।
সরেজমিন পরিদর্শন
এই প্রতিবেদক ১৯ সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনাকবলিত টাম্পাকোর লাগোয়া সোনালী ব্যাংক ভবনের ছাদে ওঠেন। এ সময় সেখানে ছিলেন স্থানীয় সাংসদ, জেলা প্রশাসক এবং উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডের লে. কর্নেল আজমসহ গাজীপুর ও টঙ্গীর সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের কর্মীরা। তখন সময় বিকেল প্রায় পাঁচটা। ধ্বংসস্তূপ থেকে তখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। লে. কর্নেল আজম সাংসদ ও জেলা প্রশাসকের উদ্দেশে বললেন, ‘ওই যে দেখুন পাঁচতলা, যার কোনো সিঁড়ি নেই। অথচ এর ওপরের অংশ গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।’ সাংসদ রাসেল বললেন, মনে হচ্ছে ভদ্রলোক টাকা আয় ছাড়া আর কিছু বুঝতে চাননি।
দুর্ঘটনা ঘটে ১০ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায়। সে কারণে কারখানার কর্মকর্তাদের কেউ হতাহত হননি। কারণ, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত শিফটে নিম্ন বেতনের শ্রমিকেরা কাজ করেন। এর মধ্যে সব থেকে বেশি বেতন (প্রায় ৩২ হাজার টাকা) পেতেন নিহত শিফট-ইনচার্জ সুভাষ চন্দ্র প্রসাদ। তাঁর স্ত্রী শঙ্খ মিত্রা চৌহান দুর্ঘটনার নয় দিন পরে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নগদ সাহায্য নিতে এসেছেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বাবা। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, তাঁর স্বামী বলেছিলেন, ‘কোনো দিন আগুন লাগলে আর বের হতে পারব না।’
সরকার ও অন্যদের দায়
শুধু বহুজাতিক সংস্থাই নয়, রানা প্লাজার চেয়ে এবারের ব্যতিক্রম হলো টাম্পাকোতে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ দায় আছে। কিন্তু এই আলোকে তারা কেউ সে বিষয়টি এখনো স্বীকার করেনি। এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড আছে সেই তালিকায়। শতভাগ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এসেনশিয়াল ড্রাগস সব সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ করে থাকে।
দেশি-বিদেশি মোট ৩১টি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে আকিজ গ্রুপ, বিডি ফুডস, মেরিডিয়ান, ফু-ওয়াং, ইউনিভার্সাল ফুডস, আবুল খায়ের গ্রুপ, মোল্লা সল্ট, হক বিস্কুট, এটিএন ফুড, নাবিস্কো বিস্কুট ও আফতাব ফুডস।
বিএটি ও নেস্লে
ঢাকায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একজন মুখপাত্র এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে ২১ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ‘সব সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তির আগেই কোম্পানির নীতিমালা অনুসারে দলিলপত্র ও কর্মপরিবেশ নিরীক্ষা করা হয় এবং তা ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। টাম্পাকোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অক্টোবর ২০১৫ সালে বিএটি টাম্পাকোর প্রয়োজনীয় সবকিছু নিরীক্ষা করে এবং তখন পর্যন্ত তা হালনাগাদ ছিল। তাদের ইএইচএস (এনভায়রনমেন্ট, হেলথ অ্যান্ড সেফটি) এবং গত জানুয়ারিতে অগ্নিনিরাপত্তা প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়েছিল।’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নেস্লে ঢাকায় প্রকাশ না করলেও ১৪ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডে টাম্পাকো বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে অবশ্য তারা টাম্পাকো দুর্ঘটনার অধিকতর তদন্তের ফলাফল জেনে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত রেখেছে। তারা বলেছে, ‘টাম্পাকো নেস্লে বাংলাদেশকেই ফয়েল সরবরাহ করে থাকে, অন্য কোনো দেশের নেস্লেকে নয়।’ এ বিষয়ে ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানতে চাইলে সুইজারল্যান্ডের নেস্লে সদর দপ্তরের মিডিয়া সহকারী মিজ ইসাবেল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নেস্লের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ‘বিশ্ববিখ্যাত ও পুরস্কার বিজয়ী আন্তর্জাতিক কারখানা পরিদর্শনকারী সুইস সংস্থা সিজিএস টাম্পাকো পরিদর্শন করে ২০১১ সালে যেসব ঘাটতি দেখেছিল, তা ২০১২ সালে মিটিয়ে ফেলা হয়েছে।’ ওই ঘাটতিগুলো কী ছিল, তা জানতে চেয়ে নেস্লের করপোরেট মুখপাত্র মিজ লিডিয়ার কাছে পাঠানো ই-মেইলের কোনো উত্তর মেলেনি।
রাসায়নিক
দুর্ঘটনার ১৪ দিনেও আগুন পুরো নেভেনি। সাংসদ রাসেল আক্ষেপ করলেন, উদ্ধারকাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ কোথায় কোন বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য কীভাবে আছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞ শ্রমিকেরা টাম্পাকোর বর্জ্য পোড়ানো বিজ্ঞানসম্মত ছিল না বলেও মত দিচ্ছেন।
২০১৫ সালের শ্রমবিধিতে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ ও মজুত বিষয়ে যেসব কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তা মানা হয়নি বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ইমারত ও কারখানা আইন না মেনে তৈরি করা অনুপযোগী ভবনে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে টাম্পাকোর সব কার্যক্রম চলছিল। আর ধ্বংসস্তূপই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলমপ্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণ তদন্তে বের হবে। কিন্তু একটি কারখানা যেভাবে চলা উচিত তা চলছিল বলে প্রতীয়মান হয় না।’
টাম্পাকো ও বিসিক মালিক সমিতির সভাপতি সৈয়দ মকবুল হোসেন দুর্ঘটনার পর রয়টার্সকে বলেছেন, ‘প্রতিটি নিয়ম মেনেই তাঁর কারখানা চলেছে।’ টঙ্গী বিসিকের দপ্তর টাম্পাকোর কোলঘেঁষে অবস্থিত। কিন্তু তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছে। টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর প্রধান কর্মকর্তা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ২২ সেপ্টেম্বর বলতেই পারলেন না যে টাম্পাকোর নথি কোথায়। শুধু বললেন, তদন্তাধীন থাকায় টাম্পাকো সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না। তিনি স্বীকার করেন, তাঁদের কোনো কারখানা পরিদর্শক নেই। দুর্ঘটনার পর বিসিকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মুজবাহ নাজ দূর থেকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ দেখে এসেছেন।
২১ সেপ্টেম্বর বিসিক মালিক সমিতি বৈঠক করেছে। কিন্তু সেখানে টাম্পাকোর কেউ ছিলেন না, তাঁদের কারও সঙ্গে কথাও হয়নি বলে জানালেন বিসিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়ন মো. মহিউদ্দিন শেখ। প্রশ্নের জবাবে তিনি অনুমান করলেন, ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা হতে পারে। ২২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সাংসদকে তিনি জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সমিতি ২০ লাখ টাকা অনুদান দেবে।
কারখানা মহাপরিদর্শকের মন্তব্য
বাংলাদেশের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, টাম্পাকো তদন্তে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার তারিখ গতকাল পেরিয়ে গেছে। তবে কমিটির অনুরোধে তাদের আরও সাত দিন সময় দেব। তিনি স্বীকার করেন, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাম্পাকো তার পরিবর্তিত লে-আউট অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল। তখন টাম্পাকো পরিদর্শন করেন বর্তমানে চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আবদুল হাই।
নিয়োগপত্র না থাকার তথ্য শুনে তিনি বিস্মিত হন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের শ্রমবিধিমতে টাম্পাকো চলছিল কি না, তা দেখা তাদেরই দায়িত্ব ছিল। কিন্তু টাম্পাকোতে সেই পরিদর্শন অন্তত গত আড়াই বছরেও হয়নি। তবে চলতি মাসে একজন পরিদর্শকের টাম্পাকো সফর অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর যাওয়ার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে।’
উল্লেখ্য, গাজীপুর অঞ্চলের কারখানার জন্য ২০ থেকে ২৫ জন পরিদর্শক আছেন। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সিঁড়িবিহীন কোনো দালানে মেশিন বসছে কি না, সেটা লে-আউটের মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, মূলত দুটি ভবনের (একটি অক্ষত) মধ্যে টাম্পাকোয় কাজ চলছিল। একটির ভেতরে অনেকগুলো উপকাঠামো ছিল। এসব দেখার কাজ ছিল বিসিকের।
এদিকে উক্ত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান ও গাজীপুরের কারখানা অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৪ সালে টাম্পাকো ইমরাত নির্মাণের যে লে-আউটের অনুমোদন নিয়েছিল, তা তারা বাস্তবে অনুসরণ করেনি। তাঁর মতে, পুরো ধ্বংস হওয়া ইমারত তিনটি, তবে এর মধ্যে দুটির নিচের মেঝে একই। তিনি স্বীকার করেন, ২০১৪ সালে তাঁর অধিদপ্তর থেকে টাম্পাকোর প্রস্তাবিত লে-আউট পরিবর্তনকে অনুমোদন করা যথাযথ হয়নি।
শ্রমিকনেতা রায় রমেশ চন্দ্র প্রতিবেদককে টেলিফোনে বলেন, গলদপূর্ণভাবে কারখানা চালানোর দায়ে মালিক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তিনি রানা প্লাজা ও তাজরীনে আইএলওর ১২১ মতে যেভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, সেটা টাম্পাকোর জন্য প্রযোজ্য বলে মত দেন। তিনি বলেন, রানা প্লাজায় একজন আহত ব্যক্তি ন্যূনতম ৫ লাখ এবং নিহত ব্যক্তির পরিবার শ্রেণিভেদে ন্যূনতম ১০ থেকে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। এ বিষয়ে টাম্পাকো-সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির নীরবতাকে তিনি দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেন।