সুন্দরবন: ঈশান কোণে কালো মেঘ

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

62be6c4526302024d3bbc5e7550db00b-1

সারা বিশ্বেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আধিক্যে জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের জন্য এই হুমকি যেন ঈশান কোণের ঝটিকার মতো কালো। কবি প্রশ্ন করেছিলেন—এ কি সত্য? উত্তর নিজেই দিয়েছেন—সকলই সত্য। আমাদের জন্য এ নিতান্তই বাস্তব—মাঝেমধ্যে আইলা-নার্গিসের রূপ ধরে ধেয়েও তো আসছে ঝটিকা। আইলার ধাক্কা বুক পেতে অনেকটাই আগলেছিল সুন্দরবন। মানুষের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ও বননিধন সত্ত্বেও সুন্দরবন তার প্রকৃতিগত সামর্থ্য দেখিয়েছিল। আর সে জন্যই সুন্দরবন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না।
এ নিয়ে কথা বলার অর্থ এই নয় যে একজন দেশপ্রেমিক অন্যজনের দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে। এটা ঠিক দেশপ্রেম পরীক্ষা নেওয়ার মতো ধাঁধা নয়।
সমস্যাটা জটিল হয় যখন সুন্দরবনকে উন্নয়নের বিপরীতে বা প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবা হয়। যাঁরা সুন্দরবন এলাকা থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সরানোর দাবি তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে উন্নয়নবিরোধী কেউ আছেন বলে মনে হয় না। এবং তাঁরা উন্নয়নের বিরুদ্ধে সুন্দরবনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন না।
সুন্দরবনকে এবং এই বদ্বীপ-ভূমির বিশেষ বনাঞ্চলটির স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য বোঝা জরুরি। এর সবটাই বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বিষয় নয়, যেমনভাবে একটি শিল্পস্থাপনাও নয় নিছক বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিষয়। নয়তো হাজারীবাগের ট্যানারি বা চন্দ্রঘোনার কাগজ কল সবই তো বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের হাতেই নির্মিত, স্থাপিত হয়েছিল। ভূমি, বসতি, নদী, জলাশয়গুলো এসব স্থাপনার কারণে একসময় কী ধরনের খেসারত দেবে এবং পরবর্তী প্রজন্ম এর কী ধরনের জের টানবে, তা ভাবনায় ছিল না। আজও যে সবাই এসব বুঝতে পারছেন, তা তো নয়।
আর এখানে সওয়ালটা হচ্ছে সুন্দরবন নিয়ে—যা কেবল ভূমি বা জলাশয় নয়, কোনো সাধারণ বসতি বা বন নয়, এটি এমন একটি জটিল জৈব রসায়নাগার, যার প্রাণবন্ত সক্রিয়তার আওতায় কেবল উদ্ভিদ বা প্রাণী নয় এমনকি পানি ও ভূমিও রয়েছে। এর প্রতি বর্গ ইঞ্চি ভূমি ও পানিতে নানা রকম প্রাণ রয়েছে এবং তারা প্রত্যেকে বিশ্বের জীবনরঙ্গ-নাট্যের কুশীলব—যেখানে সিনেমার মতো এক্সট্রা বা বাহুল্য চরিত্র নেই। সাধারণভাবে মানুষ এ বিষয়টা বুঝতে অক্ষম। বিজ্ঞানী ই ও উইলসন তাঁর ফিউচার অব লাইফ গ্রন্থে বিশ্ব নভোযানটির জটিল ভঙ্গুরতা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, জীবনের যে পূর্ণাঙ্গ রূপকে বিজ্ঞানীরা জৈবমণ্ডল (বায়োস্ফিয়ার) আখ্যা দেন, তা পৃথিবীকে ঘিরে থাকা যেন এক জৈবঝিল্লি (membrane of organism)। এটা এত পাতলা যে মহাবিশ্ব থেকে দেখা যায় না এবং এতই ক্ষুদ্রাতিÿক্ষুদ্র প্রাণসম্পদের জটিল গ্রন্থনায় ভরপুর যে যাদের নিয়ে এটি গঠিত, তাদের অধিকাংশই আজও অনাবিষ্কৃত।
এটাও ঠিক যে বিবর্তন পৃথিবী এবং প্রাণের সঙ্গী, সব সময় বিবর্তন চলছে। তবে বিলুপ্তি—ভূমি ও প্রাণের—সব সময়, বরং বলা যায়, প্রায়ই, স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এখানে মানুষের ভূমিকা বড়। তবে এ নিয়ে কোনো ফতোয়া দেওয়া যাবে না। কেননা মানুষকে তো আদিম প্রকৃতিকে জয় করে, বশ করে, পরিবর্তন করেই টিকে থাকতে হয়েছে। কথা হলো ভারসাম্য রক্ষা—সীমা টানার গুরুত্বটা বোঝা।
যেসব দেশে বড় বড় আদিম বন আছে এবং প্রচুর বনসম্পদও আছে, তারা কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করছে বা করবে?
কোচিং বা বেআইনি পশুনিধন একটি গুরুতর অপরাধ, কিন্তু কালিং বা নির্বাচিত হত্যা বৈধ। ধরা যাক, জিম্বাবুয়ে বলল তাদের বনভূমিতে ১২ হাজারের বেশি (সংখ্যাটি কাল্পনিক) হাতি থাকলে বনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে ক্ষেত্রে বাড়তি হাতি মারা যাবে। তবে বাস্তব হলো, চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্যে হাতির সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ক্যাঙারুর ক্ষেত্রে কালিং করে বলে শুনেছি।
কিন্তু সুন্দরবনের ঘটনাটা আরও আলাদা, আরও বিশিষ্ট। এটি জল ও নবীন ভূমির এমন এক ভূখণ্ডে, যেখানে বড় প্রাণীর তুলনায় পোকা পতঙ্গ ও অনুবীক্ষণীয় অণুজীবের সংখ্যা বিপুলভাবে বেশি। আর এদের ভূমিকা নিয়ে আমাদের ধারণা ও সংবেদনশীলতা খুবই কম। তথ্য হিসেবে বলি, পৃথিবীর আদিপর্বে আদিম ছারপোকা–জাতীয় প্রাণী অক্সিজেন নিঃসরণ করে আদিম পৃথিবীর বিষাক্ত আবহকে সহনীয় (আমাদের জন্য) করেছিল। তারা এ কাজ করেছিল একনাগাড়ে প্রায় শতকোটি বছর ধরে। অর্থাৎ, প্রায় অনন্তকাল ধরে তা করেছিল বলেই আমাদের পক্ষে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আসা সম্ভব হয়েছে। এ রকম কার্যকর ÿক্ষুদ্র-ক্ষুদ্রাতিÿক্ষুদ্র প্রাণে ভরপুর সুন্দরবন—যাদের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে আমরা সবটা অবগত নই।
অসম্পূর্ণ জানা নিয়ে কোনো বিতর্কের সমাধান হয় না, আদতে এটুকু প্রস্তুতিতে কোনো বিতর্কই হয় না; বরং এ রকম ক্ষেত্রে ওঠে বেনিফিট অব ডাউটের প্রশ্ন। প্রশ্নটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে, আমরা কি বেনিফিট অব ডাউট সুন্দরবনকে দেব, নাকি রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেব। এ ক্ষেত্রে আমি নির্দ্বিধায় বলব, বেনিফিট অব ডাউট পাওয়ার একমাত্র দাবিদার সুন্দরবন। কারণ, এর ভারসাম্য সামান্যও নষ্ট হলে যে ক্ষতি হবে, তার জের দেশ ও কাল উভয়ই ছাপিয়ে যাবে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রান্তিকালে সুন্দরবনে কোনো আঁচড় পড়তে না দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
এবার আরও একটি জরুরি কথা যোগ করব। এতকালের অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি, জাতি হিসেবে আমরা বন রক্ষা করতে পারিনি, বন্য প্রাণী রক্ষা করতে পারছি না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও পাহাড়ি ভূমি রক্ষা করতে চাইলে সেখানে সমভূমির বাঙালিদের বসতি স্থাপন কমাতে হবে—এমন কথা আমি অনেকবার লিখেছি। এটি একটি সাংস্কৃতিক বিষয়।
সমভূমির কৃষিসমাজের মানুষের অভ্যাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতি হলো বন কেটে বসত করা। এ বিশ্বাস আমাদের এতই মজ্জাগত যে ঝোপঝাড়ে সাপখোপ থাকতে পারে তাই কেটে সাফ করাই এখানকার সংস্কৃতি। এখানকার মানুষ সচরাচর মনে করে সাপমাত্রই বিষাক্ত। এ অঞ্চলের সামাজিক সংস্কৃতিতে সরীসৃপমাত্রের প্রতি ভয়মিশ্রিত প্রত্যাখ্যান প্রায় একচেটিয়া, এর পেছনে ধর্মীয় সংস্কারেরও ভূমিকা রয়েছে। পোকা, কীটপতঙ্গমাত্রকেই উৎপাত ও ক্ষতিকর মনে করে আমরা বিনাশে উদ্যত হই। প্রাণীর প্রতি সদয় হওয়া, আগ্রহী হওয়া, পাখিচর্চা, উদ্ভিদচর্চা—এসবই পশ্চিমের হাত ঘুরে আমাদের কাছে ইদানীংকার আগ্রহের বিষয়। তা–ও এখনো বড়লোকের বা খেয়ালি মানুষের শৌখিনতা হিসেবে এসব বিবেচ্য হয়। নয়তো বাঘ, ভালুক, সাপ থেকে মাছি—সবই তো মারার বস্তু। পাখির খাদ্যমূল্য থাকায় তার সংহারে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়।
কয়েকটি কথা আগাম বলা যায়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে আশপাশে আরও কারখানা গড়ে উঠবে, মানুষের আনাগোনা দেখে ভূমি-সংকটে জর্জরিত ভূমিহীন মানুষ ধীরে ধীরে বসতি করবে—মরিয়া (ডেসপারেট) ও সাহসী মানুষ অবশ্যই বন কেটেই বসতি করবে। এর একটা মানবিক দিকও আছে। কিন্তু জনবসতি বাড়ার অর্থ হলো সুন্দরবনকে ঘিরে ও তার ভেতর দিয়ে যেসব নদী, খাল গেছে, তাতে চলাচল বাড়বে, অর্থাৎ সুন্দরবন আরও বেশি মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালীকরণ ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার ফলে বন ও পাহাড়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়ে হিমশিম খেতে থাকা নেতাদের উদ্দেশে বিজ্ঞানী রবার্ট মে বলেছিলেন, উই আর বার্নিং দ্য বুকস বিফোর উই হ্যাভ লার্ন্ট টু রিড দেম। জীববৈচিত্র্যসহ সুন্দরবন গ্রন্থটি পড়তে শেখার আগেই আমরা সেটা পুড়িয়ে ফেলার আয়োজন করছি না তো! ভয় হয়, কারণ আমরা ঘর পোড়া গরু—মধুপুর জঙ্গল শেষ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমাগত নিঃশেষ হচ্ছে, আমার শহর চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষা করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, ক্ষতিটা ব্যক্তির হয় না, তৎক্ষণাৎ বোঝাও যায় না। কিন্তু কালের ব্যবধানে ঠিকই বোঝা যায়। উপত্যকা-অধিত্যকা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম শহরে কখনো জলাবদ্ধতা আমরা দেখিনি, আজ নগরের এটাই প্রধান সমস্যা। এর পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যার প্রধান অঙ্গ হলো পাহাড় কাটা, জমি সমতল করা।
এই পলিমাটির বদ্বীপ অঞ্চল, যার অন্য নাম প্লাবন সমভূমি বা ফ্লাড প্লেইন, তাতে আমাদের উচিত ছিল নদী ও বন্যার সঙ্গে বসবাস করতে শেখা। উন্নয়নের পশ্চিমা মডেল অনুসরণ করে আমরা কত দূর যেতে পারব, কত দিন পারব—তা–ও ভাবার বিষয়।
কিন্তু সুন্দরবন বিনিময়যোগ্য নয়, খরচ করার সম্পদও নয়, একে রেখে বেঁচেবর্তে থাকতে দিয়েই সব পরিকল্পনা ভাবতে হবে। এ নীতি নদীগুলোর ক্ষেত্রেও খাটে, বিল-হাওরের ক্ষেত্রেও, পাহাড়ের জন্যও। বর্তমান অবস্থানে রামপালের নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব সুন্দরবনের ওপর পড়বেই। মনে রাখা দরকার, এর উচ্চ প্রযুক্তির সবটাই আসবে বিদেশ থেকে অথচ আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মানস মজ্জাগতভাবে তৈরি হয়নি। সবিনয়ে বলব, আমাদের প্রকৌশলীদের, বিজ্ঞানশিক্ষকদের অধিকাংশ বিজ্ঞানমনস্ক নন, যুক্তি এবং প্রশ্নসহ শেখার প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত নন। তাই দেখি, তিন টন ওজনের একটি হাতিকে আমরা নির্বিবাদে ও দক্ষতার সঙ্গে রক্ষা করতে পারি না। সেখানে বছরে ৪৭ লাখ টন কয়লা—যত আধুনিক ব্যবস্থাই হোক না কেন—নৌকাডুবির এ দেশে স্থায়ীভাবে নিরাপদে চলাচল করবে, সে গ্যারান্টি কোথা থেকে পাব আমরা? মাঝেমধ্যে কয়লাডুবি-তেলডুবি তো হচ্ছেই। তিন টনি হাতির ক্ষেত্রে কিন্তু ভরাডুবি হয়েছে আমাদের। সুন্দরবনের বেলাতেও ভয় সেখানেই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *