ট্যাম্পাকো ট্র্যাজেডি ছেলের খোঁজে হয়রান মা পেলেন লাশ

Slider টপ নিউজ

 

31615_f3
ঢাকা; অপেক্ষায় ছিলেন। ছেলের সঙ্গে ঈদ করবেন।  ঘরে অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ। খবর পেলেন আচমকা। হঠাৎই সবকিছু তছনছ হয়ে যায় টঙ্গীর আমতলী বস্তির হরিজন কলোনির দীলিপ ডোম ও মীনা রানীর পরিবারের। তাদের ছেলে রাজেশ বাবু। ক্লিনারের কাজ করতেন ট্যাম্পাকো প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানায়। মায়ের মন কোনো কিছুই মানে না। অগ্নিদুর্ঘটনার খবর পেয়েই ছুটে আসেন। হাতে ছেলের ছবি। এখান থেকে সেখানে। গণমাধ্যমের কাছে তার আহাজারি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল, টঙ্গী মেডিকেল, কুর্মিটোলা, ঢাকা মেডিকেল কোনো জায়গা বাদ দিইনি। সারারাত আমরা খুঁজেছি। সারা রাত। নাই আমার বাচ্চা’। ট্যাম্পাকো কারখানার কাছে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তার কান্না ছুঁয়ে যায় অনেকের মন। ‘এখন একটু আমাগো ঢুকতে দেন। একটু হাতায়া মাতায়া দেখি। কিচ্ছুতো পাবো। একটু মনকে বুঝ দিমু। এইহানে বইয়া কী করি? সবাইরে দেখি। আমার বাচ্চারে তো দেখি না।’ ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাজেশের স্ত্রী শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে একটু পরপর স্বামীর খোঁজ করছিলেন। কী জবাব দেব বউয়ের কাছে, কন আপনারা। আমি তো এখানে ফকিরের মতো বইয়া রইছি। লজ্জায় ঘরে যাইতেছি না।
গত সোমবার সকালে মীনা রানীর অপেক্ষার অবসান হয়। প্রিয় সন্তানের খোঁজ পান তিনি। তবে জীবিত নয়, নিজ সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে হয় তাকে। একেই বলে বোধ হয় নিয়তি। রাজেশের পরনের জামা-কাপড়, হাতে সোনার আংটি আর  মানিব্যাগ দেখে তার মা ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। ওই দিন আরো একজনের লাশও শনাক্ত করেন স্বজনেরা। তার নাম ইসমাইল। ইসমাইলের বড় ভাই নূরুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে ভবনের ছাদের নিচ থেকে তার ভাইয়ের লাশ উদ্ধার হয়। তার সঙ্গে থাকা  মোবাইল ও আইডি কার্ড দেখে তার লাশ শনাক্ত করা হয়। তার পকেট থেকে সাত হাজার টাকাও পান তিনি। ঘটনার দিন কারখানা ছুটির পর ওই টাকা বিকাশ করে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর কথা ছিল। গ্রামের বাড়িতে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে।
এদিকে, কারখানায় বিস্ফোরণে আগুন ও ভবন ধসের ঘটনায় এখনও ১০ শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। ধ্বংস স্তূপের মধ্যে তল্লাশিও অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৪০ জন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ওদিকে এমএ হায়দার সরকার, টঙ্গী থেকে জানান, টাম্পাকো প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সোমবার সকাল থেকে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা। এদিকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ষষ্ঠদিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওই কারখানার আগুন পুরোপুরি নিভেনি। এখনও কারখানার বিভিন্ন স্থানের ধ্বংসস্তূপ থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে।
টঙ্গী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, টঙ্গীর বিসিক নগরীর টাম্পাকো লিমিটেড কারখানায় গত শনিবার ভোরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টির বেশি ইউনিটের কর্মীরা টানা চেষ্টা চালিয়ে রোববার রাতে নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত কারখানার বিভিন্ন স্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে আগুনের ধোঁয়া বেরোতে দেখা গেছে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছে। ফলে হতাহতের খোঁজে কারখানার ভেতরে এখনও তল্লাশি চালাতে পারেনি উদ্ধার কর্মীরা। ভয়াবহ এ ঘটনায় ওই কারখানার বিশাল ভবনের অধিকাংশই ধসে পড়ে বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধসে পড়ার পর ৫ তলা ভবনের অবশিষ্টাংশেও ফাটল ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। এছাড়াও আহত হয় অর্ধশতাধিক। এখনও নিখোঁজ রয়েছে দশজনের মতো। কারখানার ধ্বংসস্তূপে আরো লাশ বা জীবিত অবস্থায় কেউ আটকা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নিখোঁজদের স্বজন ও স্থানীয়রা। এ পরিস্থিতিতে সোমবার সকালে সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে একটি দল বুলডোজার ও ভেক্যুসহ ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে টাম্পাকো প্যাকেজিং কারখানায় উদ্ধার কাজ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত তারা দু’দিক থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করছিল। তবে ঘটনাস্থলে কেমিক্যালের একাধিক ড্রাম থাকায় বেশ সতর্কতার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। উদ্ধার কাজে তাদের সহায়তা করছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যরা। এর আগে উদ্ধার কাজের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য রোববার দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে।
এদিকে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম জানান, সোমবার সেনাসদস্যরা কারখানার পূর্বপাশে রাস্তার ওপর থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে ২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। এর আগে সকাল ৭টার দিকে ভবনের তৃতীয় তলার ধ্বংসাবশেষ থেকে আরো দু’জনের লাশ উদ্ধার করে। এরপর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর নর্দান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. মনোয়ার হোসাইন (৪০) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। হাসপাতালের আইসিইউর আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নাফিউল ইসলাম বলেন, তার শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুস ও খাদ্যনালী পুড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি বুকে ও মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল। গত ১০ই সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকোতে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত মনোয়ার হোসাইনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে ওই হাসপাতালের আইসিইউতে জায়গা না থাকায় নর্দান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে তালিকা পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের লাশ ইতিমধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে যে ৭টি লাশের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি, তাদের পরিচয় শনাক্তের জন্য লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা রয়েছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য অজ্ঞাত ওই ৭টি লাশ আরো কিছুদিন সেখানে সংরক্ষণ করা হবে। তাদের পরিচয় শনাক্তের পরই লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে।
কারখানার মালিক ও স্ত্রীসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা: এদিকে দুর্ঘটনায় নিহত জুয়েলের পিতা আঃ কাদের বাদী হয়ে টঙ্গী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কারখানার মালিক মকবুল হোসেন ও তার স্ত্রী শেফালী পারভীনসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অন?্য আসামিরা হলো- কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ, মহাব?্যবস্থাপক সফিকুর রহমান, ব?্যবস্থাপক (প্রশাসন) মনির হোসেন, ব্যবস্থাপক (সার্বিক) সমীর আহমেদ, ব?্যবস্থাপক হানিফ ও উপ সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি। তবে ঘটনার পর থেকে আসামীরা পলাতক রয়েছে।
বয়লার অক্ষত: টঙ্গীর টাম্পাকো লিমিটেড কারখানায় দুর্ঘটনায় গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি ছাড়াও বিশেষজ্ঞগণ ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিশেষজ্ঞগণের দাবি বয়লার বিস্ফোরণে নয়, গ্যাস লাইন লিক হয়ে টাম্পাকো কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার পরিদর্শক ইঞ্জিনিয়ার শরাফত আলী জানান, টাম্পাকো কারখানায় দুটি বয়লার রয়েছে। এগুলো আগামী ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত নবায়ন করা আছে। অগ্নিকাণ্ডের পরও কারখানার দুটি বয়লার অক্ষত আছে। তাই বয়লার বিস্ফোরণে নয়, গ্যাস লিকেজ থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে তদন্তের পর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *