ঢাকা: ভেতরে ঢুকতেই বড় সবুজ মাঠ। পাশে সাদা ধবধবে সুন্দর নকশার মসজিদ। চারপাশ ঘিরে পুরোনো ধাঁচের একই নকশা করা একতলা বাড়ি। মোট ৬০টি। সব কটি বাড়ির সামনে ফুল-ফলের গাছ লাগানো। শান্ত, ছিমছাম পরিবেশ।
তবে কলোনির বাসিন্দাদের ভাষায়, এটা ‘এক টুকরো গ্রাম’। কলোনির ভেতরে নিরাপত্তা নিয়ে এক বিন্দুও চিন্তা করতে হয় না। এখানের ছেলে-মেয়েদের বখে যাওয়ার সুযোগও খুব কম। কলোনির বাসিন্দাদের একে অপরের সঙ্গে দারুণ সখ্য রয়েছে। একের বিপদে অন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ উল্লেখ করে কারও কোনো অসংগতি চোখে পড়লেও তা এড়িয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা এখানে ঘটে না। পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন উৎসব চলে কলোনির মধ্যেই।
বিনার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বর্তমানে কলোনির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পাঁচ সদস্যের এ কমিটি গঠন করে দেয় বিনা কর্তৃপক্ষ। কলোনির ভেতরে যাঁরা থাকছেন, তাঁরাই এ দায়িত্ব পান। দুই বছর পর পর কমিটির সভাপতি পদে পরিবর্তন আসে। মোহাম্মদ আলী বলেন, কমিটির দায়িত্ব সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করা। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো ছেলে বা মেয়ে কিছুটা বখে যাচ্ছে মনে হলে তা সবার চোখে ধরা পড়ে। তখন ওই ছেলে বা মেয়ের মা-বাবাকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়। ছেলে-মেয়েরা বড়দের কথা শোনে। এ কারণে বড় অঘটন কম ঘটে।
কলোনির ভেতরে ঢুকে চোখে পড়ে বড় সবুজ মাঠ। মাঠের সঙ্গে লাগোয়া মসজিদের পাশেই একটি ক্লাব। অনির্ধারিত এক কক্ষের কয়েকটি বাসা আছে মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন বা অন্যদের জন্য। অতিথিদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এক কক্ষের একটি ঘর আছে। অন্য জায়গা থেকে অফিসের কেউ এলে বা কোনো বাড়িতে অতিথির জায়গা না হলে এখানে থাকতে পারেন। বড় কোনো খেলার সময় ক্লাবে অনেকে একসঙ্গে বসে টেলিভিশনে খেলা দেখেন। অন্য সময় সন্ধ্যার পর আড্ডা ও খেলাধুলা চলে।
কলোনির বাসাগুলোর সামনে খালি জায়গায় যে যার পছন্দ অনুযায়ী ফল ও ফুলের গাছ লাগিয়েছেন। বড় সবুজ মাঠে বিভিন্ন বয়সী ছেলে-মেয়েদের হট্টগোল, ছোট বাচ্চাদের কিচিরমিচির করতে দেখা গেল। আম, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছের পাশাপাশি লজ্জাবতী থেকে শুরু করে নানান ফুলের অসংখ্য গাছ। কমিটির পক্ষ থেকেও বিভিন্ন মৌসুমি ফুলের বাগান করা হয়।
কলোনিতে রোকসানা আরা ২১ বছর ধরে বসবাস করছেন। স্বামী বিনাতে কর্মরত। বললেন, ‘যখন এখানে আসি তখন মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আর ছেলের বয়স মাত্র আড়াই মাস। এখানেই ওরা বড় হলো। কখনোই ফ্ল্যাটের মতো বন্দী জীবন কাটায়নি। এখানে গ্রামের মতো, কেউ বিপদে পড়লে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার সামনে কোনো ছেলে বা মেয়েকে খারাপ হতে দেখিনি। এখানে ছেলে-মেয়েদের বখে যাওয়ার সুযোগটাই নেই। বাংলাদেশে এ ধরনের কলোনি এই একটিই আছে মনে হয়।’
খোরশেদ আলীর বয়স ৭৫ বছর। কলোনিতে ‘বোম্বাইয়ারা’ থাকার সময়ে তিনি কাজ করতেন। তরুণ বয়সী ছিলেন। তবে এখন বৃদ্ধ বয়সেও কলোনির বিভিন্ন কাজ করছেন। জায়গাটিকে নিজের বলে ভাবেন। তিনি বলেন, এখানকার কোনো পুলাপাইন খারাপ হইছে তা তো দেহি না। অফিসারের ছেলে-মাইয়্যারাও আমারে সালাম দেয়।’
১০ বছর ধরে থাকা রূপা পাল বললেন, ‘এ কলোনিতে সব আছে। বাচ্চারা কখনো নিজেকে একা ভাবার সুযোগ পায় না। এখানে বাচ্চারা খেলার যে সুযোগ পায়, অভিজাত ফ্ল্যাটে গিয়ে সে সুযোগ পাবে না। যে কোনো সমস্যায় প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসে। এখানে সবাই মিলে আমরা এক পরিবারের মতো থাকি।’
১৯৮৬ সাল থেকে এখানে আছেন আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, ‘এখানে ছেলে-মেয়েরা ব্যথা পেলে বা কোনো সমস্যা হলে অভিভাবকেরা পরে জানতে পারে। একদিন দেখি আমার ছেলেকে ব্যান্ডেজ করে কয়েকজন নিয়ে এসেছেন। পরে শুনলাম ও অনেক বড় ব্যথা পেয়েছিল।’