ঢাকা: আজিমপুরের সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় নিহত ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে মনে করছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। তাঁর গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, পুলিশের অভিযানের সময় আহত তিন নারীর মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাসপাতালের খাতায় তাঁর নাম লেখা হয়েছে খাদিজা। তাঁর মাথার পেছনে ধারালো অস্ত্রের কোপ আছে। তাঁকে কে কুপিয়েছে, তা জানা যায়নি। অপর দুই নারীর মধ্যে শারমিন ও শাহেলার অবস্থা স্থিতিশীল। শারমিনের পেটে ও হাতে গুলি ছিল। অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়েছে। শাহেলার পেটে ছুরির আঘাত ছিল। তাঁর অবস্থা এখনো স্থিতিশীল। তাঁরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তি এবং এই তিন নারী নব্য জেএমবির সদস্য। গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত ওই তিন নারীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে তাঁদের কোনো স্বজন বা পরিচিতজন আসেননি।
শনিবার রাতে আজিমপুরে জঙ্গিদের ভাড়া করা ওই বাসায় অভিযানের পর খবর বেরিয়েছিল যে আহত তিন নারীর একজন মিরপুরের রূপনগরে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী। তবে গতকাল পুলিশ বলছে, ওই তিন নারীর মধ্যে কেউই মেজর (অব.) জাহিদের স্ত্রী নন। তবে ওই বাসা থেকে উদ্ধার তিনটি শিশুর একটি জাহিদুলের বড় মেয়ে (৭)।
পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, ওই বাসাতেই জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহারও (শিলা) ছিলেন, বিপদ আঁচ করতে পেরে তিনি এক বছরের সন্তানকে নিয়ে কেটে পড়েছেন।
জানতে চাইলে মেজর (অব.) জাহিদের ছোট ভাই জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, যে তিনজন মহিলাকে আজিমপুরে পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে আমার ভাবি নেই। তবে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আমার ভাইয়ের মেয়ে আছে বলে শুনেছি। পুলিশ এখনো আমাদের ফরমালি কিছু জানায়নি।’
এদিকে গতকাল পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের গতকাল সকালে বলেছিলেন, নিহত জঙ্গির আঙুলের ছাপ নিয়ে তা জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, তাঁর নাম শমসেদ। বাবার নাম মোসলেহ উদ্দীন। বাড়ি রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলার মেহেরচণ্ডী গ্রামে। তাঁর সাংগঠনিক নাম আবদুল করিম। উল্লিখিত ঠিকানাটি পূর্ণাঙ্গ নয়। তারপরও ওই এলাকায় খুঁজে এ নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় পুলিশ খোঁজখবর করে এ বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি।
সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘নিহত জঙ্গি পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। আমরা ধারণা করছি তামিম আহমেদ চৌধুরীর পর এই ব্যক্তিই নব্য জেএমবির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে আমরা নগদ চার লাখ টাকা ও কয়েকটি অস্ত্র পেয়েছি।’ এই কর্মকর্তা বলেন, আজিমপুরের ওই বাসায় পাওয়া কাগজপত্র থেকে নিহত ব্যক্তির পেশা সম্পর্কে তাঁরা জেনেছেন।
পুলিশ সূত্র দাবি করছে, আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়া শাহেলা নিহত ব্যক্তির স্ত্রী। অভিযানের সময় স্বামীর মতো শাহেলাও নিজেকে নিজে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছেন। ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা তিনটি শিশুর মধ্যে ১৩-১৪ বছরের ছেলেটি এই দম্পতির যমজ সন্তানের একটি। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, যমজ সন্তানের কারণে এলাকায় তাঁরা পরিচিত হয়ে যেতে পারেন, এ আশঙ্কায় অপর ছেলেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। উদ্ধার করা তিনটি শিশুকে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে।
আজিমপুরের যে বাড়িটিতে শনিবার রাতে অভিযান পরিচালিত হয়, ওই বাড়িটি গতকালও পুলিশ ঘিরে রাখে। বাড়ির নিচে বেশ কিছু দোকান আছে। অভিযান শুরুর পরপরই দোকানের ঝাঁপ ফেলে চলে যান। তাঁরা ওই বাড়িতে থাকা কাউকে কখনো দেখেননি বলে দাবি করেছেন।
অভিযানের পুরোটা সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে দাবি করেন স্থানীয় বাসিন্দা আরমান খান। তিনি বলেন, অভিযানের সময় পুলিশের সঙ্গে তিনিও ভবনটির দোতলার ওই বাসায় যান। সেখানে এক ব্যক্তির লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁর গলায়-মাথায় রক্ত ছিল। আর এক হাতের কবজি কাটা ছিল।
বাড়ির মালিক হাজি মো. কায়সারের ছেলে মো. পারভেজ বলেন, বাড়িটির দেখাশোনা করেন তত্ত্বাবধায়ক মো. মোবারক। গত আগস্ট মাসে এক দম্পতি ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। ভাড়া নেওয়ার সময় তাঁরা তত্ত্বাবধায়ককে বলেছিলেন, মাঝে মাঝে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসতে পারে। জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি ও ছবি চাইলে ভাড়াটে গড়িমসি করছিলেন। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক পর তাঁরা কাগজপত্র দেন। সেগুলো লালবাগ থানায় জমাও দেওয়া হয়।
গতকাল দুপুরের দিকে নিহত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘ওই যুবকের গলার বাঁ পাশে গভীর কাটা ছিল। ক্ষতটি ৩ ইঞ্চি এবং চওড়া ও গভীরতায় দেড় ইঞ্চি। ধারালো অস্ত্রের আঘাত দেখে তিনি নিজেই এ কাজ করেছেন বলে ধারণা করছি আমরা। আমরা বলছি “সুইসাইডাল কাট থ্রোট উন্ড”।’ তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তির ডান হাতের কাছে ঝলসানো জখম রয়েছে। বোমা বিস্ফোরণ থেকে ওই জখম হয়েছে বলে তাঁরা মনে করছেন।