……. ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য যোগান দিতে নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা বাড়াতে জমির চাহিদাও বাড়ছে। অপরদিকে জন সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাসস্থান, দোকানপাট এবং কলকারখানা তৈরিতে চাষযোগ্য জমি ব্যবহারের ফলে দ্রুত কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য জমি। তদুপরি নদীভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাসে স্থল ভাঙ্গন এবং লবণ পানির প্রভাবে আবাদি জমির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। পরিসংখ্যাণ মতে প্রতিদিন ২০০ হেক্টর জমি অনাবাদী হচ্ছে বা হ্রাস পাচ্ছে। তাই বিকল্প চাষ পদ্ধতির কথা ভাবার সময় এসেছে। এমনএকটি অন্যতম ফলপ্রসু বিকল্প ব্যাবস্থা হচ্ছে ভাসমান চাষ পদ্ধতি। প্রাগ-হিস্পানিক যুগ থেকে এজটেক গোত্র এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আসছে। তাদের ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় চিনামপাস (chinampas)।
বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ বছর ধরে এ চাষ পদ্ধতির প্রচলণ রয়েছে । যার নাম ভাসমান বা ধাপ চাষ পদ্ধতি । বিশ্বের তাবৎ কৃষি বিজ্ঞানীরা বর্তমানে বাংলাদেশে এসে এ চাষ পদ্ধতির উপর বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে । গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, বরিশাল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি জেলা ও উপকূলীয় অন্যান্য এলাকায় বর্ষা মৌসুমে এই ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় যা এখন সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার নীচু অঞ্চলে চালু হচ্ছে। গোপালগঞ্জে একে গাউতা বলে। তাছাড়াও অঞ্চলভেদে একে বায়রা, গেটো বা ধাপ চাষাবাদও বলে। বাংলাদেশে প্রায় ৩০০০ হেক্টর জলাঞ্চলে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে দরিদ্র এবং ভুমিহীন কৃষকগন স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ এবং সহায়তা করলে দেশের সমগ্র জলাবদ্ধ অঞ্চলে (প্রায় ৭০,০০০হেক্টর) ভাসমান চাষ করা সম্ভব। জলাবদ্ধ অঞ্চল বলতে আমরা খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড়, পুকুর-দীঘি প্রভৃতিকে বুঝব। কাপ্তাই লেকের বিশাল এলাকা জুড়ে এই পদ্ধতি ব্যাবহারের আওতায় এনে প্রান্তিক কৃষকদেরর ভাগ্যের চাকা ঘুরান যেতে পারে। প্রতিটি ভাসমান বাগান তৈরিতে খরচ হয় মাত্র ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বন্যা ও জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কৌশল হিসেবে ভাসমান সবজি ও মসলা উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ নামে ভাসমান সবজি বাগান চালু করেছে। ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য প্রথমে ধাপ তৈরি করতে হবে।
ধাপ তৈরির জন্য পানির গভীরতা মুখ্য বিষয় নয়। যে কোন গভীরতায় ধাপ তৈরি করা যায়। ধাপ তৈরির কৌশল: পানিতে কচুরিপানা পঁচিয়ে জৈব সার (কম্পোস্ট) তৈরি করে কৃষকরা সফলতা পাচ্ছে। এতে করে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এ ধরণের সার তৈরিতে কৃষকরা মনোযোগী হচ্ছেন। তাদের অর্থও সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে বিষমুক্ত সবজি চাষ করতে পারছেন। এ ধরণের সার প্রয়োগ করে হাওরে ভাসমান সবজির চাষাবাদে দিন দিন কৃষকদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। এই জৈব সার দিয়ে ভাসমান বাগানে উপরের ধাপ তৈরি করে কৃষক গন প্রচুর সাফল্য পাচ্ছে। ১। কচুরিপানা জড়ো করে কিছুদিন রেখে দিলে কচুরিপানা পচে যাবে। ২। প্রথমে লম্বা একটা বাঁশ কচুরিপানার মধ্যে ফেলে দিতে হবে। ২। এরপর ঐ বাঁশের চারপাশ থেকে কচুরিপানা টেনে এনে জড়ো করে প্রথম ধাপ তৈরী করতে হবে। ৩। যতক্ষন পর্যন্ত কাঙ্খিত উচ্চতা এবং দৈর্ঘ্যের ধাপ প্রস্তুত করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত পচা কচুরিপানা বিছিয়ে ধাপের উচ্চতা বাড়াতে হবে। ৪। এরপর ৭ থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করে প্রথম স্তরের উপর আবার কচুরিপানা বিছাতে হবে। এভাবে ভাসমান পদ্ধতিতে ধাপ তৈরি করতে হবে। কৃষক ইচ্ছা করলে তার ধাপকে ভাসিয়ে অন্য কোথাও নিতে পারে। ৫। শেষ ধাপে পঁচা কচুরিপানা এবং কাঁদা মিশিয়ে বীজতল বা চারাতল তৈরী করতে হবে। বীজ বা চারা বুনার পর আর পানি দেয়ার কোন ঝামেলা নেই। পর্যাপ্ত জৈব সার থাকায় গাছের বৃদ্ধি এবং ফলন আশাতীত হয়।
————
জহির উদ্দিন বাবর, প্রভাষক
কৃষি শিক্ষা বিভাগ আবদুল মালেক কলেজ
রাজাপুর, ঝালকাঠি ।