ঢাকা: দুই বছর আগের ঘটনা। বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলায় একটি বাসায় পিস্তল নিয়ে খেলা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ৫ বছরের শিশু ফাহমিদা আক্তার প্রীতি। ওইদিন রাতে চাচার পিস্তলকে খেলনা পিস্তল ভেবে খেলা করার সময় প্রীতির কপালে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথেই প্রীতি মারা যায়। ঘটনাটি ২০১৪ সালের। একই বছরের অক্টোবরে রাজধানীর শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলির একটি বাসায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ওই বাসায় বেড়াতে আসা ৯ বছর বয়সী জান্নাত পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। তারই ফুফাতো ভাই ১০ বছর বয়সী মাহি খেলার ছলে তার বাবার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে গুলি করে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতকে। গুরুতর আহত জান্নাতকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। শিশুদের হাতে খেলনার নামে অভিভাবকরা তুলে দিচ্ছেন বন্দুক, পিস্তলসহ ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্রের ডামি। এ কারণে শিশুদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। একই সঙ্গে খেলনা অস্ত্র হাতে নেয়ার ফলে শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পরিবর্তন ঘটছে। তারা শৈশব থেকেই নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে গিয়ে আক্রমণাত্মক হিসেবে গড়ে তুলছে। মনো. বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ব্যাপকভাবে। জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের হাতে যে ধরনের অত্যাধুনিক ও ভয়ঙ্কর অস্ত্র দেখা যাচ্ছে, একই আদলের খেলনা অস্ত্র শিশুদের হাতেও শোভা পাচ্ছে। আবার শিক্ষিত সচেতন অভিভাবকরাও তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন এসব খেলনা অস্ত্র। ফলে, শিশু বয়সেই তারা অস্ত্রের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করছে। এটি একই সঙ্গে যেমন নেতিবাচক, তেমনি ভাবনারও বিষয়। একই মারণাস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে শিশু সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও মনোবিশ্লেষকরা সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। খেলনা অস্ত্রের বদলে তাদের হাতে সৃজনশীল খেলনা সামগ্রী তুলে দেয়ারও আহবান জানান তারা। একই সঙ্গে শিশুদের নির্মল ও সুস্থ বিনোদন, তাদের জীবনাচার এবং খেলাধুলার জন্য সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ তৈরি করার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট, পল্টন, চকবাজার এলাকায় শিশুদের খেলনা অস্ত্র পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয় এমন কিছু দোকান ও শো-রুম ঘুরে বিক্রেতা, ক্রেতা ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহার করে এমন অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে নির্ধারিত মূল্যে। স্নাইপার রাইফেল, শটগান, মেশিনগান, এসএমজি (শট মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), একে ৪৭-এর আদলে একে ৭৪, একে ২২, এয়ারগান, স্টেনগান, একে ৮৬৮, একে ৮১৮ উইপন্স, একে ৭৯৮ সহ নানা ধরনের মারণাস্ত্রের আদলে খেলনা অস্ত্র অবাধে বিক্রি হচ্ছে ১শ’ থেকে ২ হাজার টাকায়। নৈতিকতার দিক থেকে এ বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয় স্বীকার করে বিক্রেতারা জানান, এ ধরনের খেলনা অস্ত্র বিক্রিতে তারা কোনো বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন না। তবে, এসব খেলনা অস্ত্রে গুলি বা এ ধরনের কোনো ব্যবহার নেই। ট্রিগারে চাপ দিলে শব্দ হয়ে আলো বের হয়, গুলির মতো শব্দ হয়। তাতে ক্ষতির কোনো কারণ নেই। সরকারের তরফে যদি কোনো আইন করা হয়, তাহলে তারাও এসব খেলনা অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেবেন বলে জানান বিক্রেতারা। তারা আরো জানান, প্রায় সব শ্রেণির অভিভাবকই এসব মারণাস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র তাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ডি ব্লকের বেবি কর্নারের স্বত্বাধিকারী এম এ মান্নান মানবজমিনকে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ জঙ্গি সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র তারা বিক্রি করেন। এসব অস্ত্রের প্রায় সবই দেশের বাইরে বিশেষ করে চীন থেকে আমদানি হয় বলে জানান তিনি। তবে, নীতিমালা বা আইন না থাকায় এ ধরনের খেলনা অস্ত্র বিক্রিতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না বলেও জানান এম এ হান্নান। একই এলাকার পপুলার গিফট কর্নারের মো. রফিক বলেন, বেশির ভাগ অভিভাবকই এসব খেলনা অস্ত্র বাচ্চাদের দিতে চান না। কিন্তু বাচ্চারা এসবের জন্য কান্নাকাটি করে। জেদী আচরণ করে। কোনো কোনো বাচ্চা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাদেরকে কিনে দিতে হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে জঙ্গি, সন্ত্রাসীরা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাতে আমরা খেলনা অস্ত্র বিক্রি করলেও নৈতিকতার দিক থেকে মনে করি শিশুদের হাতে এ ধরনের খেলনা অস্ত্র তুলে দেয়া ঠিক নয়।
নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবির মানবজমিনকে বলেন, খেলনা মারণাস্ত্র শিশুদের হাতে তুলে দেয়ার অর্থই হচ্ছে অপরাধপ্রবণতার জন্য তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো। এসব খেলনা অস্ত্র পেলে শিশুরা একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে, খেলা করে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিক বিবেচনা করলে বিষয়টি একেবারেই অনুচিত। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে আমি কখনই চাইবো না এ ধরনের খেলনা মারণাস্ত্র বিশেষ করে জঙ্গি, সন্ত্রাসীরা যেসব ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র ব্যবহার করে তা শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হোক। তিনি বলেন, বিক্রেতারা এসব বিক্রি করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। চাইলেই বন্দুক, পিস্তল কিনে দিতে হবে, এটা ঠিক নয়। আর যারা এসব আমদানি রপ্তানি করে তাদের বিরুদ্ধে আইন করে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তারা হয়তো লুকিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি। খুশি কবির বলেন, যেকোনো নিষিদ্ধ কাজেইতো অভিভাবকরা শিশুদের বারণ করেন। এক্ষেত্রেও তাদের বারণ করা উচিত।
রাজধানীর অভিজাত শপিং মল বসুন্ধরার লেবেল-১, ব্লক সি এর সারা টয় ওয়ার্ল্ড’র স্বত্বাধিকারী মো. রশিদ টুটুল বলেন, এসব খেলনা অস্ত্রের সবই আসে চীন থেকে। এ বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আর চাহিদা আছে বলেই আমরা তা বিক্রি করি। আর এসব খেলনা অস্ত্রের কোনোটিতেই গুলি কিংবা এ ধরনের শব্দ নেই। সরকার যদি আইন করে তা বন্ধ করতে চায় আমরাও বিক্রি বন্ধ করে দেব। একই এলাকার ঝলক টয়’র দুই কর্মচারী মাছুম ও আকাশ বলেন, অনেক বাবা-মা এর নেতিবাচক দিকটি বোঝে। কিন্তু যেসব বাচ্চা নাছোরবান্দা ও জেদি তারা ঠিকই তা আদায় করে নেয়। বুধবার দুপুরে বসুন্ধরা শপিং মল-এর লেবেল-১, ক্লক-সি-এ শিশুদের খেলনার শো-রুমে দুই ছেলেকে খেলনা কিনে দিতে এসেছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী এ জেড এম ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, দুই ছেলেকেই প্লাস্টিক গাড়ি কিনে দিয়েছি। আত্মীয়র সন্তানদের জন্যও গাড়ি ও ফুটবলের খেলনা কিনেছি। আমি আমার দুই ছেলেকে কখনই খেলনা বন্দুক, পিস্তল রাইফেল এসব কিনে দিই না। তারা চাইলে কান্নাকাটি করলেও না। এসব অস্ত্র হাতে পেলে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হতে পারে। তাই সকল অভিভাবককেই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। আর আইন করে এসব খেলনা অস্ত্র তৈরি ও আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করতে পারলে আরও ভালো।
মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ মানবজমিনকে বলেন, এ ধরনের খেলনা অস্ত্র ব্যবহারের ফলে শিশুর মধ্যে নেতিবাচক মানসিকতা যেমন তৈরি হয় তেমনি তার মধ্যে সত্যিকার অস্ত্র ব্যবহারের বাসনা তৈরি হয়। ছোটবেলায় যখন সেই শিশু বন্দুক পিস্তল নিয়ে অন্যকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে বড় হয়ে অনেকের মধ্যেই এ ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়। তিনি বলেন, একটি শিশুকে নষ্ট করার জন্য আমাদের চারদিকে অনেক কিছুই আছে। যখন একটি শিশু অভিভাবকদের সঙ্গে কোনো খেলনার দোকানে যায় তখন এ ধরনের খেলনা অস্ত্র দেখে তার মনে কি এগুলো ব্যবহার করার বাসনা জাগবে না? কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি আমরা নিজেরাই তাদের জন্য তৈরি করে দিচ্ছি। আমরা যতই প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ততই বেশি আমাদের বাচ্চারা ভালনারেবল হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই এ বিষয়ে নীতিমালা রয়েছে। আমাদের দেশেও এ বিষয়ে নীতিমালা থাকা উচিত।
শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি এমরানুল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই কোন বয়সের এবং কোন মানসিকতার শিশুরা কি ধরনের খেলনা ব্যবহার করবে সে নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু আমদের দেশে এ নিয়ে কোন নীতিমালা নেই। তাই, অবাধে যেমন ভয়ঙ্কর সব খেলনা মারণাস্ত্র বিক্রি হচ্ছে তেমনি অভিভাবকরাও তা শিশুদের কিনে দিচ্ছে। এতে করে শিশুদের উল্টো মানসিকতা কাজ করছে। বিশেষ করে যেসব শিশু খেলনা অস্ত্র হাতে পায় তারা শিশু বয়স থেকেই নিজেকে শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক হিসেবে গড়ে তুলছে। তার মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। এতে করে পরিবার ও সমাজেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে এর কিছুটা প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আইন ও নীতিমালার পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা এক্ষেত্রে জরুরি বলে আমি মনে করি।
রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট, পল্টন, চকবাজার এলাকায় শিশুদের খেলনা অস্ত্র পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয় এমন কিছু দোকান ও শো-রুম ঘুরে বিক্রেতা, ক্রেতা ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহার করে এমন অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে নির্ধারিত মূল্যে। স্নাইপার রাইফেল, শটগান, মেশিনগান, এসএমজি (শট মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), একে ৪৭-এর আদলে একে ৭৪, একে ২২, এয়ারগান, স্টেনগান, একে ৮৬৮, একে ৮১৮ উইপন্স, একে ৭৯৮ সহ নানা ধরনের মারণাস্ত্রের আদলে খেলনা অস্ত্র অবাধে বিক্রি হচ্ছে ১শ’ থেকে ২ হাজার টাকায়। নৈতিকতার দিক থেকে এ বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয় স্বীকার করে বিক্রেতারা জানান, এ ধরনের খেলনা অস্ত্র বিক্রিতে তারা কোনো বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন না। তবে, এসব খেলনা অস্ত্রে গুলি বা এ ধরনের কোনো ব্যবহার নেই। ট্রিগারে চাপ দিলে শব্দ হয়ে আলো বের হয়, গুলির মতো শব্দ হয়। তাতে ক্ষতির কোনো কারণ নেই। সরকারের তরফে যদি কোনো আইন করা হয়, তাহলে তারাও এসব খেলনা অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেবেন বলে জানান বিক্রেতারা। তারা আরো জানান, প্রায় সব শ্রেণির অভিভাবকই এসব মারণাস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র তাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ডি ব্লকের বেবি কর্নারের স্বত্বাধিকারী এম এ মান্নান মানবজমিনকে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ জঙ্গি সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্রের আদলে তৈরি খেলনা অস্ত্র তারা বিক্রি করেন। এসব অস্ত্রের প্রায় সবই দেশের বাইরে বিশেষ করে চীন থেকে আমদানি হয় বলে জানান তিনি। তবে, নীতিমালা বা আইন না থাকায় এ ধরনের খেলনা অস্ত্র বিক্রিতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না বলেও জানান এম এ হান্নান। একই এলাকার পপুলার গিফট কর্নারের মো. রফিক বলেন, বেশির ভাগ অভিভাবকই এসব খেলনা অস্ত্র বাচ্চাদের দিতে চান না। কিন্তু বাচ্চারা এসবের জন্য কান্নাকাটি করে। জেদী আচরণ করে। কোনো কোনো বাচ্চা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাদেরকে কিনে দিতে হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে জঙ্গি, সন্ত্রাসীরা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাতে আমরা খেলনা অস্ত্র বিক্রি করলেও নৈতিকতার দিক থেকে মনে করি শিশুদের হাতে এ ধরনের খেলনা অস্ত্র তুলে দেয়া ঠিক নয়।
নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবির মানবজমিনকে বলেন, খেলনা মারণাস্ত্র শিশুদের হাতে তুলে দেয়ার অর্থই হচ্ছে অপরাধপ্রবণতার জন্য তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো। এসব খেলনা অস্ত্র পেলে শিশুরা একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে, খেলা করে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিক বিবেচনা করলে বিষয়টি একেবারেই অনুচিত। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে আমি কখনই চাইবো না এ ধরনের খেলনা মারণাস্ত্র বিশেষ করে জঙ্গি, সন্ত্রাসীরা যেসব ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র ব্যবহার করে তা শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হোক। তিনি বলেন, বিক্রেতারা এসব বিক্রি করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। চাইলেই বন্দুক, পিস্তল কিনে দিতে হবে, এটা ঠিক নয়। আর যারা এসব আমদানি রপ্তানি করে তাদের বিরুদ্ধে আইন করে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তারা হয়তো লুকিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি। খুশি কবির বলেন, যেকোনো নিষিদ্ধ কাজেইতো অভিভাবকরা শিশুদের বারণ করেন। এক্ষেত্রেও তাদের বারণ করা উচিত।
রাজধানীর অভিজাত শপিং মল বসুন্ধরার লেবেল-১, ব্লক সি এর সারা টয় ওয়ার্ল্ড’র স্বত্বাধিকারী মো. রশিদ টুটুল বলেন, এসব খেলনা অস্ত্রের সবই আসে চীন থেকে। এ বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আর চাহিদা আছে বলেই আমরা তা বিক্রি করি। আর এসব খেলনা অস্ত্রের কোনোটিতেই গুলি কিংবা এ ধরনের শব্দ নেই। সরকার যদি আইন করে তা বন্ধ করতে চায় আমরাও বিক্রি বন্ধ করে দেব। একই এলাকার ঝলক টয়’র দুই কর্মচারী মাছুম ও আকাশ বলেন, অনেক বাবা-মা এর নেতিবাচক দিকটি বোঝে। কিন্তু যেসব বাচ্চা নাছোরবান্দা ও জেদি তারা ঠিকই তা আদায় করে নেয়। বুধবার দুপুরে বসুন্ধরা শপিং মল-এর লেবেল-১, ক্লক-সি-এ শিশুদের খেলনার শো-রুমে দুই ছেলেকে খেলনা কিনে দিতে এসেছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী এ জেড এম ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, দুই ছেলেকেই প্লাস্টিক গাড়ি কিনে দিয়েছি। আত্মীয়র সন্তানদের জন্যও গাড়ি ও ফুটবলের খেলনা কিনেছি। আমি আমার দুই ছেলেকে কখনই খেলনা বন্দুক, পিস্তল রাইফেল এসব কিনে দিই না। তারা চাইলে কান্নাকাটি করলেও না। এসব অস্ত্র হাতে পেলে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হতে পারে। তাই সকল অভিভাবককেই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। আর আইন করে এসব খেলনা অস্ত্র তৈরি ও আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করতে পারলে আরও ভালো।
মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ মানবজমিনকে বলেন, এ ধরনের খেলনা অস্ত্র ব্যবহারের ফলে শিশুর মধ্যে নেতিবাচক মানসিকতা যেমন তৈরি হয় তেমনি তার মধ্যে সত্যিকার অস্ত্র ব্যবহারের বাসনা তৈরি হয়। ছোটবেলায় যখন সেই শিশু বন্দুক পিস্তল নিয়ে অন্যকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে বড় হয়ে অনেকের মধ্যেই এ ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়। তিনি বলেন, একটি শিশুকে নষ্ট করার জন্য আমাদের চারদিকে অনেক কিছুই আছে। যখন একটি শিশু অভিভাবকদের সঙ্গে কোনো খেলনার দোকানে যায় তখন এ ধরনের খেলনা অস্ত্র দেখে তার মনে কি এগুলো ব্যবহার করার বাসনা জাগবে না? কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি আমরা নিজেরাই তাদের জন্য তৈরি করে দিচ্ছি। আমরা যতই প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ততই বেশি আমাদের বাচ্চারা ভালনারেবল হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই এ বিষয়ে নীতিমালা রয়েছে। আমাদের দেশেও এ বিষয়ে নীতিমালা থাকা উচিত।
শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি এমরানুল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই কোন বয়সের এবং কোন মানসিকতার শিশুরা কি ধরনের খেলনা ব্যবহার করবে সে নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু আমদের দেশে এ নিয়ে কোন নীতিমালা নেই। তাই, অবাধে যেমন ভয়ঙ্কর সব খেলনা মারণাস্ত্র বিক্রি হচ্ছে তেমনি অভিভাবকরাও তা শিশুদের কিনে দিচ্ছে। এতে করে শিশুদের উল্টো মানসিকতা কাজ করছে। বিশেষ করে যেসব শিশু খেলনা অস্ত্র হাতে পায় তারা শিশু বয়স থেকেই নিজেকে শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক হিসেবে গড়ে তুলছে। তার মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। এতে করে পরিবার ও সমাজেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে এর কিছুটা প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আইন ও নীতিমালার পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা এক্ষেত্রে জরুরি বলে আমি মনে করি।