রিশার ঘাতক ওবায়দুল গ্রেফতার

Slider জাতীয় টপ নিউজ

14212822_1531926946833123_4869822012411036916_n

 

ঢাকা: রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসা (১৪) হত্যার ঘটনায় বখাটে ওবায়দুল খানকে (২৯) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, আজ বুধবার সকালে নীলফামারী থেকে ওবায়দুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

মারুফ হোসেন বলেন, রিসাকে ছুরিকাঘাত করার পর ওবায়দুল দিনাজপুরে পালিয়ে যান। সেখানে পুলিশ হানা দেওয়ার আগেই তিনি সরে পড়েন। এরপর যান ঠাকুরগাঁও। সেখান থেকে নীলফামারীতে যান। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নীলফামারীর ডোমার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমেদ রাজিউর রহমান বলেন, সকাল আটটার দিকে উপজেলার সোনারায় বাজার থেকে ওবায়দুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া গত বুধবার পরীক্ষা শেষে স্কুলের সামনের পদচারী-সেতু দিয়ে সড়কের ওপারে যাওয়ার সময় এক বখাটে তাকে ছুরিকাঘাত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার সুরাইয়া মারা যায়। এ ঘটনায় তার মা তানিয়া হোসেন রমনা থানায় এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের একটি দরজির দোকানের কর্মী ওবায়দুলকে আসামি করে মামলা করেন।

ওবায়দুলের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মিরাটঙ্গী গ্রামে।

কে ওবায়দুল
ওবায়দুল। স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশার ঘাতক হিসেবে উঠে এসেছে তার নাম। সে লেখাপড়ার পাঠ চুকায় স্কুল জীবনেই। বখে যায় বেশ আগেই। তার বখাটেপনা সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়েছে পুলিশ। বখাটে থেকে একজন ‘খুনি’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে ওবায়দুল। তাকে গ্রেপ্তার করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি টিম দিনাজপুরে যায়। একটু আগেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওবায়দুল সম্পর্কে জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মিরাডঙ্গী গ্রামের মৃত আবদুস সামাদ পাইকারের পুত্র সে। তার পিতা একজন শ্রমজীবী মানুষ। গ্রামে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল ওবায়দুল। বাধ্য হয়েই দরিদ্র পিতা তাকে ঠাকুরগাঁও জেলা সদরে নিয়ে যান কাজের সন্ধানে।
১৫ বছর বয়সে ম্যাজিক কার্ট টেইলার্সে শুরু হয় তার কর্মজীবন। আবদুস সামাদ পাইকারের সংসারে অভাবের কারণে তার ছেলে ওবায়দুলকে কাজ দিয়েছিলেন টেইলার্সের মালিক গৌরাঙ্গ। গৌরাঙ্গের বাসায় থাকতো সে। গৌরাঙ্গের আন্তরিকতার কারণেই টেইলার্সের সকল কাজ শিখতে পারে ওবায়দুল। ২০০৮ সালে গৌরাঙ্গের টেইলার্স থেকে বের হয়ে পাশের ডলফিন টেইলার্সে কাজ করে ওবায়দুল। ২০০৯ সালে ওবায়দুলের বাবা আব্দুস সামাদ পাইকার মারা যান। ২০১০ সালে বেশি উপার্জনের জন্য ওবায়দুল পাড়ি জমায় ঢাকায়।
সর্বশেষ রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং মলের তৃতীয় তলার বৈশাখী  লেডিস টেইলার্সে কর্মরত ছিল ওবায়দুল। থাকতো একটি মেসে। প্রায় এক বছর বৈশাখী টেইলার্সে কাটিং মাস্টার হিসেবে ছিল। ওই সময়েই মা তানিয়া হোসেনের সঙ্গে ওই টেইলার্সে যায় সুরাইয়া আক্তার রিশা। তখনই ওবায়দুলের কুনজরে পড়ে এই কিশোরী। রিশার মা তানিয়া হোসেন জানান, দর্জির দোকানে রিশাকে নিয়ে যাওয়াটাই তার কাল হয়েছে। ওই দর্জিই তার বাচ্চা মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। প্রায় ছয় মাস আগে রিশার জন্য জামা তৈরি করতে তাকে সঙ্গে নিয়ে বৈশাখী টেইলার্সে যান তানিয়া।  দোকানের রসিদে বাসার ঠিকানা ও একটি মোবাইলফোন নম্বর দেয়া ছিল। ওই মোবাইলফোনটি রিশা ও তার মা দুজনেই ব্যবহার করতেন। তানিয়া হোসেন জানান, ওই নম্বর পেয়েই তার উত্ত্যক্ততা শুরু হয়। অচেনা ফোন নম্বর থেকে পরিচয় না দিয়ে কল দিতো ওবায়দুল। রিশাকে নানা কথা শোনাতো। বিষয়টি মা তানিয়াকে জানায় রিশা। বাধ্য হয়ে ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন তানিয়া। তাতেও থামেনি ওবায়দুল। তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেই যাচ্ছিলো। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে তাকে অনুসরণ করতো। প্রায়ই সিদ্দিকবাজারে রিশাদের বাসার পাশে অবস্থান করতো। তানিয়া নিজে তা দেখেছেন বলে জানান। এভাবে প্রায়ই প্রেমের প্রস্তাব দিতো এই বখাটে। বিষয়টি বৈশাখী টেইলার্সের মালিক জাকির হোসেনকে জানিয়েছিলেন রিশার মা তানিয়া। এ বিষয়ে জাকির হোসেন জানান, কাজে অমনোযোগী ছিল ওবায়দুল। ঠিকমতো কাজ করতো না। এরমধ্যেই রিশার মা তানিয়া তার কাছে অভিযোগ করেন যে তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে ওবায়দুল। ওই অভিযোগের পর গত রমজানে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে জানান তিনি।
বখাটে এই যুবক হুমকিও দিয়েছিলো রিশার পিতাকে। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে রিশাদের বাসায় ফোন করে ওবায়দুল। এসময় ডিশ লাইন সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলার বাহানা দিয়ে রমজানের মোবাইল নম্বর নেয়। এক সপ্তাহ আগে রমজানকে ফোন করে সে বলে, আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। নইলে আপনার মেয়েকে হত্যা করা হবে। কিন্তু বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি রমজান।
গত ২৪শে আগস্ট দুপুরে কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজের ওপরে ওবায়দুল রিশাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং পরে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার সকালে রিশা মারা যায়। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এই ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশার হত্যাকারী ওবায়দুলকে সাত দিনেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গত সোমবার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুলিশ ৪৮ ঘণ্টা সময় চেয়ে অঙ্গীকার করে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টায়ও খুনি ওবায়দুলকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় আবারও সড়ক অবরোধ করেছে তার সহপাঠীরা। তবে ওবায়দুল যেন পালাতে না পারে, এ জন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। রমনা জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ওবায়দুলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য গত সোমবার ইমিগ্রেশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া, তাকে গ্রেপ্তার করতে দিনাজপুরে একজন এডিসিসহ পুলিশের একটি টিম অবস্থান করছে। যে কোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান তিনি।
সূত্রে জানা গেছে, গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের আগে রোববার পর্যন্ত  গ্রামে ছিল ওবায়দুল। সোমবার থেকে সে আত্মগোপনে চলে গেছে। বিষয়টি স্বীকার করে উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সর্দার  বলেন, যেখানেই থাকুক তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ জন্য পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারা কাজ করছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তৃতীয় দিনের মতো রিশার হত্যাকারীর গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে রাস্তায় নামে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। কাকরাইল মোড়ের রাজমনি সিনেমা হলের সামনে মূল সড়কে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। এতে কাকরাইলসহ আশেপাশের সড়কে প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে মেয়ের হত্যাকারীর বিচার দাবিতে সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন রিশার বাবা-মাও। রিশার বাবা রমজান হোসেনের উপস্থিতিতে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা নব উদ্যমে গর্জে ওঠে। রমজান আলীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা তাকে মাথায় পানি ঢেলে ও বাতাস করে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। টানা আন্দোলনের মাধ্যমে দোষীকে বিচারের আওতায় এনে ফাঁসির রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত রিশার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেয় সহপাঠীরা। নিশার মাও কাকরাইলে চলমান আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। প্রচণ্ড গরমের কারণে তিনি কাকরাইল মোড়ে এসে অবস্থান না করলেও আশেপাশেই অবস্থান নিয়েছেন বলে জানান তারা। পুলিশ সময় নিয়েও খুনিকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা।
এদিকে, ওবায়দুলের বোন খাদিজা বেগম (৩৬) ও ভগ্নিপতি খাদেমুল ইসলাম (৪৬)কে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মিরাডঙ্গী গ্রাম থেকে আটক করেছে পুলিশ। তাদেরকে ওবায়দুল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *