১০ বছরের স্বর্ণা। এই বয়সেই চোখের সামনে ঘটে গেল দুটি লোমহর্ষক খুন। ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেল সে। একটি খুন প্রায় আড়াই বছর আগের। তার চোখের সামনেই আপন ভাই সোহান ইসলামকে কুপিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। আর অপরটি হচ্ছে জন্মদাতা পিতা তাজুল হত্যাকাণ্ড। পিতার রক্তাক্ত দেহ আগলে ধরে তাকে বাঁচানোর জন্য আর্তনাদ করলেও তাৎক্ষণিক কেউ এগিয়ে আসেনি। দুটি ঘটনার পর অনেকটা হতবাক সিলেটের শিশু স্বর্ণা। হয়ে পড়েছে বাকরুদ্ধ। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠে সে। দুই লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী স্বর্ণা সিলেটের খুলিয়াপাড়া আবাসিক এলাকার চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে। তার মা ওই এলাকার সাবেক কাউন্সিলর শাহানা বেগম শানু। পিতা ছিলেন ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম। তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নেতাও। প্রথম ঘটনা ২০১৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি। তখন স্বর্ণা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তাকে স্কুল থেকে আনতে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে যায় বড় ভাই সোহান ইসলাম। সোহান সিলেটের মদনমোহন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। স্বর্ণার পরিবারের লোকজন জানায়, সোহান ছোটো বোন স্বর্ণাকে মোটরসাইকেলের পিছনে নিয়ে খুলিয়াপাড়াস্থ বাসায় ফিরছিল। পথিমধ্যে লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পথ আগলে দাঁড়ায় ঘাতকরা। এলাকার রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের কয়েকজন মোটরসাইকেল থামিয়ে সোহানকে উপর্যূপরি কুপাতে শুরু করে। চোখের সামনে ভাইয়ের উপর হামলার দৃশ্য দেখে চিৎকার শুরু করে স্বর্ণা। কিন্তু তার চিৎকারে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরবর্তীতে সোহান খুনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে স্বর্ণা জানিয়েছিল পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পায়নি। এই খুনের ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্বর্ণা একাধিকবার পুলিশের মুখোমুখি হয়েছিল। জানিয়েছিল চেনা খুনিদের নামও। তবে, ঘটনার পর স্বর্ণা অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলে মা শাহানা বেগম শানু তাকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গেছেন। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টায়। সন্ত্রাসী হামলার শিকার বড়ভাই রায়হানকে নিয়ে মা শাহানা বেগম শানু চিকিৎসার জন্য ভারত চলে গিয়েছিলেন। বাসায় ছিল স্বর্ণা ও তার পিতা তাজুল ইসলাম। রাতে যখন খুলিয়াপাড়ার গরম দেওয়ান (রহ.) মাজারের সামনে পিতা তাজুল ইসলামকে ঘাতকরা কোপায় তখন অদূরেই বাসায় দ্রুত খবর পৌঁছে যায়। স্বর্ণা এ সময় পিতার অপেক্ষায় বাসাতেই ছিল। খবর পেয়ে সে দৌড়ে সবার আগে চলে আসে ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে ঘাতকদের উপর্যুপরি কোপে রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন তাজুল ইসলাম। আশপাশে তেমন কোনো মানুষজন ছিল না। যারা ছিলেন তারা অনেক দূরে থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন। স্বর্ণা পিতার এই অবস্থা দেখে স্থির থাকতে পারেনি। দৌড়ে গিয়ে রক্তাক্ত দেহের ওপর লুটিয়ে পড়ে। চিৎকার করে সবার কাছে পিতাকে বাঁচানোর জন্য সাহায্য চায়। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এক পর্যায়ে পিতার মুখে থাকা রক্ত সরাতে স্বর্ণা দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পার্শ্ববর্তী একটি চায়ের দোকানে। পানি নিয়ে এসে পিতার মুখে লেপটে থাকা রক্ত ও চুন সরায়। এ সময় সে হাউমাউ করে কাঁদছিল। পরে স্বজনরা গিয়ে তাজুলকে উদ্ধার করেন। স্বর্ণা জানায়, তার পিতার রক্তাক্ত দেহ গাড়িতে তোলার সময় পিতা তাজুলের কিছুটা জ্ঞান ছিল। তাজুল ওই সময় তাকে বলেছে, ‘যাও মা বাড়ি যাও। সুস্থ হয়ে আমি ফিরে আসবো।’ কিন্তু পিতা তাজুল আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন না। লাশ হয়ে ফিরতে হলো তাকে। গতকাল পিতার মরদেহ দেখে স্থির থাকতে পারল না স্বর্ণা। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তার আর্তনাদে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত লোকজন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই নিজের ভাই ও পিতার দুটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে গেল সে। স্বর্ণার পিতা তাজুলের পরিবারের ট্র্যাজেডির কাহিনী এখন সিলেটের মানুষের মুখে মুখে। নানান মর্মান্তিক ঘটনা বলে বেড়াচ্ছেন লোকজন। শনিবার নিহত তাজুল ইসলাম স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী হলেও তার পরিবারকেন্দ্রিক সিরিজ খুনের ঘটনা ঘটেছে জমিজমার বিরোধকে কেন্দ্র করেই। খুন হওয়ার প্রায় বছরখানেক আগে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন তাজুল ইসলাম। ওই সময় একই স্থানে তার উপর হামলার ঘটনা ঘটেছিলে। ওই সময়ও ঘাতকরা তাজুলকে কুপিয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ চিকিৎকার পর তিনি সুস্থ হন। প্রায় ৫ মাস আগে একই স্থানে হামলার শিকার হয় তাজুলের বড় ছেলে রায়হান ইসলামও। চোখে মরিচ ও চুন ছিটিয়ে রায়হানকে কোপানো হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখনও রায়হান সুস্থ হননি। পা পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। আর বাম চোখেও কিছু দেখতে পারেন না। পিতার খুনের সময় মা শানুকে নিয়ে রায়হান চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিলেন। পিতার খুনের সংবাদ শুনে গতকাল সকালে বাড়ি ফিরেছেন।