গ্রাম বাংলা ডেস্ক: সনদ বাতিল হওয়া মুক্তিযোদ্ধা সচিবেরা এখনো বহাল তবিয়তে। এ নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও এ তিন সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রশাসনেও এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেয়া এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদৌ কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে কি নাÑ তা নিয়েও সন্দেহ-অবিশ্বাস ডালপালা ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড় চলছে। এত বড় জালিয়াতির পরও তারা কিভাবে এখনো বহাল আছেনÑ এ প্রশ্ন এখন প্রশাসনের সর্বস্তরে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রতারণা করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার চেয়ে বড় অসদাচরণ আর কী হতে পারে। জালিয়াতি করে সনদ নেয়া এসব কর্মকর্তার সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের সাধারণ নাগরিকসহ প্রশাসনের বিভিন্নস্তরের কর্মকর্তারা।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশের পর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত সোমবার এক সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ স্থগিত ও চার সচিবের (একজন যুগ্ম সচিব) সনদ বাতিল করা হয়। এরপরও এ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের নীরব অবস্থানের কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপশি সাধারণ মানুষও হতবাক হয়েছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ দ্রুতই পদপে নেবেন-এমনটাই আশা করছেন তারা। গত ৮ সেপ্টেম্বর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঁচ সচিবের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত ১৪ সেপ্টেম্বর এক সভায় পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। প্রসঙ্গত ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীর অসদাচরণের সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি। এ ছাড়া পদাবনতি, বার্ষিক প্রণোদনা স্থগিত ও তিরস্কারের বিধানও রয়েছে।
সনদ বাতিল হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন, স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন (মো: নিয়াজউদ্দিন মিয়া), যিনি বর্তমানে জাতিসঙ্ঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব বর্তমানে ওএসডি কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব এ কে এম আমির হোসেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব বর্তমানে ওএসডি আবুল কাশেম তালুকদার। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তার ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য যে পাঁচটি ধাপ পেরোতে হয় তিনি (মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান) তার চারটিই সম্পন্ন করেছেন। শেষ ধাপটি সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাড়াহুড়া করেছেন। এতে তার কোনো ত্রুটি নেই। ফলে তাকে আপিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আপিলের সুযোগ দেয়ার মানেই হচ্ছে)Ñ তার বিষয়টি ঝুলিয়ে দেয়া। অর্থাৎ মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অপবাদ থেকে আপাতত পার পেয়ে যাচ্ছেন-এমনটাই ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
তার ব্যাপারে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক আলাপকালে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা একই এলাকার মানুষ। একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমার দু-এক বছরের সিনিয়র হবেন। ফলে তাকে ভালোভাবেই চিনি ও জানি। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, ভুয়া সনদ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এ কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে খাটো করেছেন। পুরো প্রশাসনকেই খাটো করেছেন। প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধও করেছেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করেছেন। এত বড় অপরাধের পর তাদের কোনো শাস্তি না হওয়াটা লজ্জার ব্যাপার। অভিযুক্ত কর্মকর্তারা বহাল থাকায় ওই দফতরের শীর্ষ ব্যক্তিরাও বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। তারা মনে করেন, বিষয়টি যত দ্রুত সুরাহা হবে, প্রশাসনের জন্য ততই মঙ্গল।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগ ওঠার সাথে সাথেই এসব কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হওয়ার কথা। কিন্তু ভুয়া সনদ বাতিলের পরও তারা চাকরিতে বহাল থাকাটা প্রশাসনের জন্য খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। তা ছাড়া এটি প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের নীতি-নৈতিকতারও প্রশ্ন। বিষয়টি প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করেন তিনি।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতারণা করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার চেয়ে বড় অসদাচরণ আর কি-ই বা হতে পারে। প্রতারণার মতো অসদাচরণের দায়ে তাদের অবশ্যই শাস্তি পাওয়া উচিত। প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে আমরা লজ্জিত। একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আবার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীও হয়েছেন, এটা কিভাবে সম্ভব। তারা বলেন, ভুয়া সনদ নিয়ে কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করেছেন। এটা আমাদের সবার জন্যই লজ্জার। এসব কর্মকর্তার জন্য আমরা বিব্রত বোধ করছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে এ ঘটনা প্রশাসনে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।