আইএসের তথ্য ও ছবি আদান–প্রদান করতেন ৪ নারী

Slider জাতীয় নারী ও শিশু

c942432591f5d28c7fa81a2dc992870a-Untitled-34

ঢাকা: জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার চার নারী তাঁদের মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে আইএস-সমর্থিত বিভিন্ন সাইটে যেতেন। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে আইএসের তত্ত্ব, তথ্য, ছবি, অডিও ও ভিডিও ডাউনলোড এবং নিজেদের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া করতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য ও অনুসন্ধানে এসব জানা গেছে।

র‍্যাব বলছে, গ্রেপ্তার চার নারী মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আকলিমা রহমান মনি, ইশরাত জাহান মৌসুমি, খাদিজা পারভিন মেঘলা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশিকে দীক্ষা দিয়েছেন মাহমুদুল হাসান তানভির। এই মাহমুদুল হাসান নতুন ধারার জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখার আমির। ‘তাজরিয়ান আনহার’ নামে ফেসবুকে তাঁর একটি আইডি আছে। তাঁর অনুসরণকারীর সংখ্যা ৪৫২। তাঁদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের নারী, জামায়াত-শিবিরের শিশু সংগঠন ফুলকুঁড়ির আসরও রয়েছে। তিনি তাঁর পাতায় নারীদের ‘দ্বীনি বোন’ বলে সম্বোধন করতেন। হিজাব-বোরকা থেকে শুরু করে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), পয়লা বৈশাখ, ইংরেজি নববর্ষ উদ্‌যাপনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার ও উদ্‌যাপন প্রতিরোধের ডাক দিতেন। গ্রেপ্তার নারীরা তাঁকে অনুসরণ করতেন, পোস্টে লাইক ও শেয়ার দিয়েছেন। গত ২১ জুলাই মাহমুদুল হাসানকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। তাঁর কথার ভিত্তিতেই ১৫ আগস্ট এই চার নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার চার নারীর মধ্যে আকলিমা রহমান ও ইসতিসনা আক্তার নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতেন বলে অনুসন্ধানে জেনেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে ধানমন্ডির একটি মসজিদে আকলিমার সঙ্গে ইসতিসনার পরিচয় হয়। আকলিমা সে সময় তাঁকে মাহমুদুল হাসান সম্পর্কে এবং আইএসের সঙ্গে মাহমুদের পরিচয়ের কথা জানান।

আকলিমা প্রথমে তাঁকে পেনড্রাইভে আইএসের বিভিন্ন খবরাখবর ডাউনলোড করে সরবরাহ করতেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ইসতিসনা আক্তার হ্যাকিং এড়াতে আইএস-নির্দেশিত অ্যাপ ব্যবহার করতেন। এই অ্যাপ ব্যবহার করে তিনি আইএস-সমর্থিত বিভিন্ন সাইটে যেতেন। যখনই কোনো সাইটে ঢুকতে অসুবিধা হয়েছে, তখনই তিনি অন্য কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করে সাইটগুলোয় যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া ফেসবুকে তাঁর বিদেশি বন্ধুদের মাধ্যমেও তিনি বিভিন্ন পোস্ট পেতেন ও শেয়ার করতেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই দলের অপর সদস্য ইশরাত জাহান দলে ভেড়ান খাদিজা পারভিনকে। তাঁরা দুজনেই মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ে থাকেন। খাদিজা ফেসবুকে অধরা ধ্রুব নামে আছেন। ২০১৬ সালে ইশরাত জাহান, ‘নবুওয়াত আদলে খিলাফত, সারা মুসলিম উম্মায় একজন খলিফা থাকতে পারবেন। তিনিই সারা বিশ্ব শাসন করবেন’—এই বক্তব্য লিখে খাদিজাকে বন্ধু হওয়ার আহ্বান জানান। মাস দু-তিনেক আগে তাঁরা ‘ব্লাড রোজ’ নামে ফেসবুকে আলাদা একটি গ্রুপ খোলেন।

গতকাল মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ে ইশরাত জাহানের বাসায় গেলে তাঁর পরিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদককে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়নি। প্রতিবেশীরা বলেন, ইশরাত জাহানকে এলাকার কেউ কোনো দিন দেখেনি। তিনি বোরকা-হিজাব, হাতে-পায়ে মোজা ও চশমা ব্যবহার করতেন। মাস চারেক আগে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে ওই বাড়িতে ওঠেন। পাশের বাড়ির এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌরা (ইশরাত) যখন এই বাসায় ওঠে, তখন তার সঙ্গে এক বস্তা বই ছিল। ১৫ আগস্ট সকালে যখন তাকে র‍্যাব-পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তখনো তার সঙ্গে এক বস্তা বই নিয়ে গেছে।’

ইশরাতের বাড়ির লাগোয়া একটি বাসায় এক কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকতেন খাদিজা পারভিন। প্রতিবেশীরা প্রথম আলোকে বলেন, প্রায়ই দিন দশেকের জন্য তিনি উধাও হয়ে যেতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে ও মাথায় কাপড় দিত। রোজার মাসে আমার সঙ্গে যখন তার দেখা হলো, তখন সে দেখি বোরকা-হিজাব, হাত মোজা-পা মোজা পরে বসে আছে। আমি তার সঙ্গে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার নিয়ে কথা বলতে চাইতাম। সে শুনতে চাইত না। তবে, আমার বিশ্বাস, সে নতুন এই দলে ভিড়েছে।’

আমাদের শেরপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার হাতীবান্ধায় খাদিজার বাড়িতে গেলে তাঁর মা হোসনে আরা দাবি করেন, ‘আমার মেয়ে কখনো এ ধরনের কাজ করতে পারে না। আমার মেয়েকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে। আর কারও প্ররোচনায় পড়ে সে যদি এমন কাজ করেও থাকে, তবে তাকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ তিনি তাঁর মেয়ের মুক্তি দাবি করেন। হাতীবান্ধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দু-তিন দিন আগে খাদিজার বাবা খোরশেদ আলম মেয়ের চাকরির কথা বলে আমার কাছ থেকে একটি চরিত্রগত সনদ নিয়েছেন। আমরা জানি, সে (খাদিজা) ভালো। তবে সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না, সে বিষয়টি আমি জানি না।’

এদিকে ইসতিসনা আক্তারের বাবা ঢাকা মেডিকেল কলেজের বক্ষব্যাধি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিশ্বাস আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতে আমার মেয়ের সঙ্গে আমার একটু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। ও বলেছে, বান্ধবীরা আমাকে কিছু জিনিস দেখিয়েছিল, আমি শুধু পড়ে দেখেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু করিনি।’ তাঁর মেয়ে ঘটনার শিকার বলে দাবি করেন তিনি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তার নারীরা সত্যিই জেএমবির সঙ্গে যুক্ত কি না, ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। এর আগে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া নারীদের কেউ কেউ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্য ছিলেন। তবে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, ওই নারীরা সদ্য নিয়োগ পাওয়া বা দাওয়াতি শাখার সদস্য হয়ে থাকতে পারেন।’

মিরপুর মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হওয়া ওই চার নারীকে পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়। ঢাকা মহানগর হাকিম প্রণব কুমার হুই তাঁদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এদিকে ইসতিসনার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার খবরে কলেজের ‘একাডেমিক কাউন্সিল’ গতকাল জরুরি সভা ডাকে। ওই সভায় কলেজের সব অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অংশ নেন। পরে সাতজনের একটি দল মেয়েদের শহীদ আলীম চৌধুরী হল ও ছেলেদের শহীদ ফজলে রাব্বী হল পরিদর্শনে যান। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ইসমাইল খান। এদিকে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসবিরোধী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তিন ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *