গণতন্ত্রের বিকল্প মঞ্চ!

Slider তথ্যপ্রযুক্তি

27517_f1

 

ঢাকা:  আড্ডা। চায়ের কাপে ঝড়। গ্রাম থেকে শহর। এই একটি ক্ষেত্রেই ব্যবধান সামান্য। যত মত তত পথ। আড্ডায় উজির-নাজির মারার ক্ষেত্রে বাঙালির খ্যাতি বহুদিনের। সময় অবশ্য বদলে গেছে। রাজনীতির মাঠে এখন আর ঝড় নেই। চায়ের দোকান অথবা চলন্ত বাসে আগের মতো ‘আলাপি’ মানুষের দেখা মিলে না। তার বদলে খেয়াল করে দেখবে, স্কিনে বন্দি হয়ে যাচ্ছে মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব লাখ লাখ মানুষ। তারা প্রতিনিয়ত নির্মাণ করছেন তাদের নিজেদের আনন্দ, বেদনা ও হতাশার গল্প। রাজনৈতিক আলোচনাও থেমে নেই।

যেকোনো ইস্যুতে এখন সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ইস্যুটির কথাই ধরা যাক না কেন। গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত ফেসবুক দুনিয়ার বাসিন্দারা। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধীরা চালাচ্ছেন একটি যৌথ প্রচারণা। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের বরাতে রাষ্ট্রের মালিকানা দাবি করে তারা লিখছেন, তারা সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চান না। তারা উন্নয়ন চাইলেও সুন্দরবন ধ্বংস করে তা চান না। রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত ফেসবুকের ওয়ালে হাজির করছেন তারা। বসে নেই রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষের লোকজনও। নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তারা বলছেন, রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ। আর বিদ্যুতের জন্য অপরিহার্য রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প।
সমকালীন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি প্রধানতম ঘটনা গণজাগরণ মঞ্চ। এ মঞ্চ নির্মাণে প্রধান ভূমিকা রাখে সোশ্যাল মিডিয়া। আরেকটু হলফ করে বললে ফেসবুক। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় সবেমাত্র ঘোষণা হয়েছে। ফেসবুকে অনেকেই প্রতিবাদ, হতাশা প্রকাশ করছিলেন। ফেসবুকে একটি ইভেন্ট খোলা হলো শাহবাগের সমবেত হওয়ার ডাক দিয়ে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। বিকাল নাগাদ হাজার হাজার মানুষ ভিড় করলো শাহবাগে। পরেরটা পুরোটাই ইতিহাস। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক ডাক নিয়ে হাজির হলো শাহবাগ। আন্দোলনের চাপে সংশোধন হলো আইন। পরে আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডের রায় এলো কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। সিলেটে শিশু রাজনের খুনিদের গ্রেপ্তার আর দ্রুত বিচারেও প্রধান ভূমিকা রাখে সোশ্যাল মিডিয়া। রাজনকে নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ফুঁসে উঠে জনতা। সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচারের দাবিও সর্বপ্রথম উচ্চকিত হয় ফেসবুক দুনিয়ায়। সম্প্রতি গুলশান হামলার হোতাদের চিহ্নিত করতেও ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হামলাকারীদের ছবি দেখে দ্রুতই তাদের চিহ্নিত করেছেন ফেসবুক দুনিয়ার বাসিন্দারা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়াতেই হারানো মানুষের খোঁজ পেতে এখন সহায়ক ভূমিকা রাখছে ফেসবুক। আরব বসন্তের পেছনেও প্রধান ভূমিকা রাখে সোশ্যাল মিডিয়া। যদিও আরবের দেশগুলোর জন্য ওই বসন্তের পরিণতি ভালো হয়নি।
রাজনীতির নানা ইস্যুতে বিভিন্ন দলের কর্মীরা প্রায়ই বাহাসে লিপ্ত হন ফেসবুকে। যদিও বাংলাদেশের বড় দলগুলোর দলীয় প্রধান ফেসবুকে সরব নন। কিন্তু তাদের নানা বক্তব্য নিয়ে, অবস্থান নিয়ে কর্মী-সমর্থকরা ফেসবুকে বিতর্কে মাতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে সরব। প্রায়ই নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজের মতামত দেন তিনি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতারই ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে ওবায়দুল কাদের, শাহরিয়ার আলম, জুনায়েদ আহমেদ পলককে সবচেয়ে সরব দেখা যায় ফেসবুকে। বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তারা ফেসবুককে ব্যবহার করে থাকেন। সাম্প্রতিক বিএনপির কমিটি নিয়ে দলটির কর্মী-সমর্থকরা ফেসবুকে নানা মত দিয়েছেন। অন্যান্য দলের কর্মী-সমর্থকরাও মন্তব্য করেছেন কমিটির ভালো-মন্দ নিয়ে।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার সবকিছুই যে ভালো তা নয়। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এক ধরনের সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ তৈরি করে। যারা বহু ক্ষেত্রেই তাদের চার পাশের মানুষ থেকে, বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়। খেলার মাঠ, বই আর সংস্কৃতি যে এখনকার তারুণ্যকে খুব একটা টানে না এর জন্য অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই নানামুখী হয়রানির শিকার হয় নারী। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে সন্ত্রাসবাদীরা। জঙ্গিরা তাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য ব্যবহার করছে সোশ্যাল মিডিয়াকে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করছে সদস্য। এক্ষেত্রে অবশ্য বেশি ব্যবহৃত হয় টুইটার। সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হওয়া গুজবের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৈরি হয় সংঘাত-সহিংসতার। ফেসবুক দুনিয়ায় অনেক বাসিন্দাদেরই পরমতসহিষ্ণুতা নেই। সম্প্রতি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন লিখেছেন- সবাই এখানে শব্দের চাপাতি হাতে।
সোশ্যাল মিডিয়া কি বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠছে? একথা সত্য, পৃথিবীর বহু দেশেই গণমাধ্যমকে নানা ধরনের সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে অর্থে তেমন কোনো সেন্সরশিপ নেই। ফেসবুক দুনিয়ার মানুষের হাত বাঁধা নেই, তাদের চোখ খোলা। তারা যা কিছু দেখেন তাই লিখতে পারেন। নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন অনেকটা নিঃসংকোচে। মূলধারার মিডিয়া কোনো খবর চাপা দিতে চাইলেও চাপের মুখে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কাছ থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে অনেক চাপা পড়া সংবাদও প্রকাশ করতে বাধ্য হয় মিডিয়া।
এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক বলেন, সামাজিক গণমাধ্যম একটা ‘নতুন মিডিয়া’। মালিকপক্ষের নীতি, বিদ্যমান আইন অথবা গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেক বিষয় মূলধারার গণমাধ্যম প্রচার করে না। কিন্তু, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বাধ্যবাধকতা না থাকায় তারা অনেক তথ্য প্রচার করছে। এটা একদিকে মূলধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে এটা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর খবরের জন্য অন্যতম সোর্স হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই। এটা রাষ্ট্রীয় সীমানার গতানুগতিক ধারণাকে বদলে দিয়েছে। এক দেশের বিষয়ে অন্য দেশের মানুষ মত প্রকাশ করতে পারছে। এক দেশের ইস্যুতে অন্য দেশের নাগরিকরা ক্যাম্পেইনও করছে। আবার বিভিন্ন বিষয়ে প্রবাসী নাগরিকরা বা প্রবাসী বিশেষজ্ঞরাও মতামত দিতে পারছে। তবে, দুঃখজনকভাবে অনেকে একে খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। সামাজিক গণমাধ্যমের সৃজনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যবহারকারীদের এসব বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এই শিক্ষক।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেসবুক গণতন্ত্রের অনেকটা বিকল্প মঞ্চ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও মাঝে মধ্যেই মত প্রকাশ করতে গিয়ে বিপত্তির মুখেও পড়ছেন ফেসবুক দুনিয়ার বাসিন্দারা। তবে এ কথাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন, মার্ক জুকারবার্গ প্রতিষ্ঠিত ফেসবুক বিশাল বাণিজ্যেরও নাম। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকে ১০ শতাংশ আইডি কোনো মানুষের নয়। বাণিজ্যিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হয়েছে এইসব আইডি। তবে যতই সমালোচনা থাকুক না কেন, মানুষের মত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ফেসবুক এক অসামান্য আবিষ্কার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *