মুই চিড়া, নুন আর চাউল নিব্যারনুম। তোমরা মোক থালি, হাড়ি, হাস-মুরগি, খ্যাতা-বালিশ আর একান চোকি আনি দেও। ঘরখান ঠিক করি দেও। দোয়া করিম বাবা। দেখতে দেখতে সব ভাসি গেলো, কিচ্ছু বুঝবার পালুম না। একন কিচ্ছু নাই। খালি হাত পাও আর গায়ের কাপড় খ্যান নিয়া বাচি আছোম। বলছিলেন, গাইবান্ধা ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়িয়া গ্রামের প্রতিবন্ধি ভুষণ চন্দ্র’র স্ত্রী কল্পনা রানী। বাঁধের পাশে অন্যের জায়গায় একটি ছাপড়া ঘরে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে বাস করতেন তারা। স্বামী প্রতিবন্ধি। এক রাতে নদীর শনশনি শব্দ আর থরথর করে বাঁধের কাঁপুনি অনুভব করে মনে হচ্ছিলো ভুমিকম্প হচ্ছে। ভরা গাঙ্গের পানির চাপে সিংড়িয়া বাঁধ ধ্বসে যায় তখন। আর শ্রোতের চাপে কাঁপতে শুরু করে আশ পাশের গ্রাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষের চিৎকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে অন্যদের সঙ্গে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওঠেন পাশের উচু বাঁধে। এরই মধ্যে তার প্রতিবন্ধি স্বামীকে নিতে পারেননি। শ্রোতের তোড়ে ভেসে যান তিনি। কিছু দূরে গিয়ে ভেসে উঠলে পরে অন্যরা তাকে উদ্ধার করে। সবাই যার যার মতো বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। মুহুর্তেই এভাবে সিংড়িয়া গ্রামের অনেক কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। রাতে কিছু দেখা যায়নি। সকালে দেখা গেল ওই গ্রামটি পানির নিচে তলিয়ে আছে। ঘরের টিন পর্যন্ত পানি আর প্রবল শ্রোত। শ্রোতে ভেসে গেছে অন্তত ২০ টি বাড়ির ৫০ টি ঘর। তার মধ্যে একটি টিনের ছাপড়া ঘর ছিলো দরিদ্র কল্পনা রানীর। অনেক পরিবারের গরু ছাগল আর মানুষ বাঁচাতে পারলেও বিধবা কলপনার ৬টি মুরগি, ২টি কম্বল, ৪টি হাড়ি, থালা, ২টি বালিশ আর চৌকি ও ছাপড়ার টিন বাঁচাতে পারেননি। ঘুমের মধ্যে কল্পনা তার সন্তানকে নিয়ে কোন মতে দৌড় দিয়ে বাঁধে ওঠেন । তারপর চার পাশ অন্ধকার দেখে বসে পড়েন ঘরবাড়ি হারা অন্য মানুষের কাছে। সেই থেকে কল্পনা এক কাপড়ে আছেন। বাঁধে বসে বসে মানুষের আসা যাওয়া, সাহেবদের চলাচল আর মানুষের আহাজারি দেখেন। দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে আর তাকিয়ে থাকেন তার ছাপড়ার দিকে। কিন্তু তার ছাপড়ার চিহ্নও নাই। আশে পাশের ঘরগুলো কোনটা ভেসে গেছে, কোনটা ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। আবার কোন ঘর হেলে পড়েছে। গাছের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শ্রোত। শ্রোতের মধ্যে শুধু চালের অংশ দেখা যায়। কল্পনা ৩শ গজ দুরে ভেঙ্গে যাওয়া বাধে অন্যদের সাথে ঠায় বসে থাকে খোলা আকাশের নিচে। নেই রান্না, খাওয়া আর ঘুমের চিন্তা ছাপিয়ে তার চিন্তা এখন মাথা গোঁজার ঠাই। তিনি বলেন, দুর দুরন্ত থেকে সাহেব আসেন, মন্ত্রী আসেন আর ডাল-চাল দিয়ে চলে যান। কল্পনার কাহিল অবস্থা দেখে তার প্রতি সবাই সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দেন ডাল, চাল, চিনি, চিড়া, দেশলাইসহ নানা সরঞ্জাম। কিন্তু কেউ দেয়না মাথা গোঁজার ঠাই। কলপনা এখন বাধের এক পাশে অন্যের গরু-বাছুরের পাশে ভেজা পাটের বস্তার ওপর থাকেন। সবাই যা খায় তিনিও তাই খান। খাবার নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। আছে শুধু আশ্রয় নিয়ে দৃশ্চিন্তা। তার ঘরের জায়গা এখন দরিয়া। শুধু পানি আর শ্রোত। থাকবেন কোথায় তা তার অজানা। কল্পনা বলেন, হামার কেউ নাই। একটা টিনের ছাপড়া আর খ্যাতা কাপড় আছিলো তাও ভাসি গেছে। শীত আলে কোতে থাকমো, এই চিন্তায় ঘুম হয়না। শেষ বয়সে মরার আগে মোর গতি কেটা করবে বাবা? সগলে আসি খালি চাইল, ডাল, তেল, নুন, মোমবাাতি, চিড়া দেয়। মুই ইগলা দিয়া কি করিম? কেউ কয় না বলে একবান টিন দেমো, ঘর তুলি থাকিস। মোক তোমরা চাউল দেন না, চোকি আর ছাপড়া আনি দেও। ঘরহারা এই বৃদ্ধের অভিযোগ ভগবান মোর পেট বাজাবে, তোমরা মোক মাথা গোজার ঠাই করি দেও। উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, আমরা চেষ্টা করছি তাদের পুনর্বাসন করার। ববাদ্দ পেলে তালিকা তৈরী করে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।