তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন ‘তলোয়ার দিয়ে’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন, আল-কায়েদার ইয়েমেনি নেতা আনওয়ার আল-আওলাকির বক্তৃতা শুনে অনুপ্রাণিত হতেন। তাঁরা তাঁকেও এ বক্তৃতা শোনাতেন, মোহাম্মদপুরের একটি মসজিদে বাংলা খুতবা শুনতে যেতে বলতেন। ছাত্রটি বলছেন, টুকটাক তর্কবিতর্কের পর তাঁরা তাঁকে আর এসব কথা বলেন না।
অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলছেন, তাঁর এক নিকটজন কয়েক মাসের মধ্যে সাজপোশাক আর ধর্মপালনে কট্টরপন্থী হয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ওই ছেলেটি এখন পরিবারের মেয়েদের পর্দা করতে আর ঘরে থাকতে বলছেন। জঙ্গি তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ছেলেটির পরিবার এখন তাঁকে নিয়ে খুব চিন্তিত।
আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলছেন, তাঁদের কমনরুমের নামাজের ঘরে বছর খানেক আগেও দু-তিনজন ‘বড় আপু’ আট-দশজনের দলে নিয়মিত ধর্মীয় আলোচনার আয়োজন করতেন। সেসব আলোচনায় একপর্যায়ে তাঁরা ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব করার কথা বলতেন। তিনি কয়েকটি বৈঠকে গিয়ে আর যাননি।
ঢাকাবাসী অনেক তরুণই এখন পরিচিতজনদের আচরণ-কাজকর্ম নিয়ে নতুন করে ভাবছেন।প্রথম আলোরসঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা চলমান জঙ্গি তৎপরতা এবং জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে তাঁদের বিভ্রান্তি আর আতঙ্কের কথা বলেছেন। তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত। একজন যেমন বলেছেন, দাড়ি রাখেন ও টুপি পরেন—এমন যে কেউ এখন সন্দেহের মধ্যে।
মালিবাগে কোচিং সেন্টারে: হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া বিলকিসের (১৭) আতঙ্ক কাটছে না—‘প্রায় আমাদের বয়সী কিছু মানুষ আমাদের বয়সী অন্যদের মারছে, এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।’
২১ জুলাই সন্ধ্যায় সুমাইয়ারা ১০ জন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী মালিবাগে একটি কোচিং সেন্টারে পড়তে এসেছিল। খিলগাঁওয়ের ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজের আলভী আহমেদ বলল, ‘আমাদের প্রজন্মে এমন অনেকেই আছে, যাদের ধর্ম সম্পর্কে ধারণা কম, কিন্তু তারা ধর্ম পালনে আগ্রহী। এদের ভুল তথ্য দিয়ে জঙ্গি দলগুলো আকৃষ্ট করতে চাইছে।’
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলল, ‘এখন ফেসবুকে অনেক পাতা আছে, যেখানে ধর্মের নামে নানা উসকানি দেওয়া হয়।’ এদের মতে, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ধর্মের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাকে পাঠ্যসূচিতে রাখা দরকার।
সন্দেহ, সংকট ও জিজ্ঞাসা
২৪ জুলাই রাত আটটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) বারান্দায় একে একে জড়ো হলেন ঢাকার দুটি পাবলিক ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছয়জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের এমবিএর ছাত্র তানজীদ মাহমুদের মনে অনেক প্রশ্ন—‘যা দেখছি, এগুলোই কি সত্য? গুলশানের ঘটনায় নিহত জঙ্গিরা আইএসে কতটা সক্রিয় ছিল? ওদের মেরে ফেলা হলো কেন? মূল পরিকল্পনাকারী কারা? পেছনের সত্যটা কোনো দিন কি জানা যাবে?’
গত জুলাই মাসে গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় এবং কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন জঙ্গি ১৬ জন তরুণ নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে বিভিন্ন কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আছেন। পাঁচজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) পড়তেন—একজন অল্প সময়ের জন্য।
এনএসইউতে বিবিএ পড়ছেন আবরার শরীফ খান। বললেন, গণমাধ্যমগুলো ঢালাওভাবে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কে দুষছে—‘গুলশানে তো নিবরাসদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের নেতার ছেলেও ছিল। এখন আমরা কি বলব, ওই দল জঙ্গি তৈরির কারখানা?’
শরীফ নিজে ছেলেদের বিশ্রামাগার বয়েজ লাউঞ্জে থাকা নামাজের ঘরে নিয়মিত জোহরের নামাজ পড়েন। বললেন, সামনাসামনি কোনো আপত্তিকর কিছু কখনো দেখেননি। তাঁর সহপাঠী আবীর আহমেদ খানের মতে, এমন যোগসাজশ প্রকাশ্যে হবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ বেশি।
নিয়ামত আলী খান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিল্প ও উৎপাদন কৌশল বিভাগে পড়ছেন। বুয়েটে ঢোকার পর থেকে সেখানে তিনি নিষিদ্ধঘোষিত ধর্মীয় সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সক্রিয়তার কথা শুনেছেন। তবে বললেন, ‘সামনাসামনি দেখিনি।’
অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক এই সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে ২০০১ সালে এ দেশে কাজ শুরু করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদেও এ সংগঠনের তৎপরতার অভিযোগটি পুরোনো। হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় সাত শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে। তাঁদের ছয়জনই এই অনুষদের। ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবদুল মুকিত বলছেন, গত বছর সিসিটিভি ক্যামেরায় মেয়েদের কমনরুমে ধর্মীয় সংগঠনের লিফলেট বিলি করতে দেখা গেলে এসব কাজ নিষিদ্ধ করা হয়।
মুকিত বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চার-পাঁচ বছরে সবার জীবনেই কোনো না কোনো বড় সংকট আসে।’ পরীক্ষার ফলাফল, খাপ খাওয়ানো, বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া—যেকোনো কারণেই সংকট হতে পারে। কিন্তু তখন সহায়তা করার কেউ থাকে না। পরিবারের কাছে তাঁরা মন খুলে কথা বলতে পারেন না। সাংবাদিকতার ছাত্র আশরাফুল গণি বলেন, এ রকম সময়ে তাঁদের ভুল পথে নেওয়া সহজ।
মুকিত বলেন, মানসিক সংকটে কাউন্সেলিং বা পেশাদার পরামর্শ সহায় হতে পারে, ‘কিন্তু আমাদের সমাজে কাউন্সেলিং নিলেই তাকে পাগল ভাবা হয়।’
তানজীদের মতে, তরুণদের বড় অংশ ধর্মবিশ্বাসী, যদিও সবাই হয়তো চর্চায় নিয়মিত না। আর খুব ছোট একটি দল পুরোপুরি অবিশ্বাসী। মাঝামাঝি বলে কিছু নেই।
ধর্ম, জিহাদ, আদর্শ ও সমাধান
ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় ফাজিল (স্নাতক) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ওসামা হক ৬ আগস্ট টেলিফোনে বলেন, ‘আগে আমাদের দিকেই সবাই আঙুল তুলত। এখন তো বোঝা গেল অন্য ছেলেরাও এর সঙ্গে জড়িত।’ তাঁর সহপাঠী জুবায়ের আবদুল্লাহ্ বললেন, ‘ধর্ম এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে না।’
মাহাদী হাসান শিহাব যশোরের একটি মাদ্রাসা থেকে আলিম (উচ্চমাধ্যমিক) পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তাঁর মতে, এ দেশে আলিয়া মাদ্রাসায় সাধারণ শিক্ষার অংশ আছে। সেখানে এককভাবে শুধু ধর্ম সম্পর্কে পড়ানো হয় না। আর কওমি (দেওবন্দি) মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে সমসাময়িক কোনো বিষয়েই ধারণা দেওয়া হয় না। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সংকট রয়ে যায়।
মার্কিন নেতৃত্বে আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে কওমি মাদ্রাসার পরিচিত শিক্ষার্থীদের শিহাব বলতে শুনেছেন, এটা ইসলামের ঘরে হামলা। তাঁরা ওই সব দেশে গিয়ে জিহাদ করতেও চাইতেন। কিন্তু তাঁর মতে, সেসব ভাবনার সঙ্গে এখনকার জঙ্গিদের জিহাদের কোনো মিল নেই। সাঈদ আহমেদ ঢাকার একটি ক্যাডেট মাদ্রাসায় দাখিল পর্যায়ে (এসএসসি) পড়ছে। সে বলেছে, অতীতে জঙ্গিবাদী দলগুলোর নেতারা কওমি মাদ্রাসার নিম্নবিত্ত ছেলেদের ইসলাম রক্ষার কথা বলে ‘খারাপ নিয়তে’ দলে ভেড়াত।
২৬ জুলাই বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর এলাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ক্লাস শেষে এলেন আলী আজম। তিনি পরিবারে শিখেছেন, ধর্ম মানুষকে সাহায্য করতে বলে। কারও ক্ষতি না করতে বলে। তাঁর সহপাঠী শামীমা আক্তার শিক্ষা পেয়েছেন ভিন্নধর্মী কাউকে জোর না করতে। তিনি বললেন, ‘আমার ধর্ম সবার সঙ্গে মিশতে বলেছে, ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করতে বলেনি।’
এঁদের প্রায় সবাই মনে করেন, উগ্রপন্থায় যারা যাচ্ছে তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানা-বোঝা গভীর নয়। শামীমা বলছেন, ‘কোরআন অনেক বড়। একেক অংশে একেক পটভূমিতে একেক কথা বলা হয়েছে। পটভূমি ছাড়া খণ্ডিত কথা শুনলে তো চলবে না।’
মিরপুরের একটি সরকারি কলেজের গণিত বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, ইসলামের শিক্ষা দিয়েই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তিনি বললেন, ‘জিহাদ হচ্ছে যেকোনো খারাপ কিছুর প্রতিবাদ করা, জিহাদ মানে কেবল সহিংসতা না। আর এখন তো জিহাদের মতো কোনো পরিস্থিতি হয়নি। আমরা তো সবাই স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারছি।’
আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী শোয়েব আহমেদ পারিবারিকভাবে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি বললেন, ইসলাম জিহাদের কথা অবশ্যই বলে—‘তবে সেটা শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এভাবে মানুষ হত্যা করা জিহাদ না।’
আলোচনায় কয়েকজন ইসলামসহ সব ধর্মের সঠিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিলেন। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ইমনের কথায় সঠিক দিকনির্দেশনার চাহিদা বড় হয়ে আসে। তিনি বলেন, নানা বিষয়ে ঠিক-ভুল নিয়ে মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। বুঝিয়ে দেবেন এমন কাউকে খুঁজে পান না।
অন্তত দুজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বললেন, ছোটবেলা থেকে তাঁরা দেখছেন যে রাজনীতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। দেশে হিংসা-বিদ্বেষ যেন আদর্শে পরিণত হয়েছে। তাঁদের মতে, হিংসা-বিদ্বেষের চর্চা আর ভিন্নমতের দমন বন্ধ করা না হলে এ দেশ থেকে জঙ্গিবাদ কখনো যাবে না। সমাজে আর শিক্ষায় নানা ভাগ থাকাটাও সমস্যা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ থেকে সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় এসেছেন রাকিবুল হাসান। তাঁর বড় ভাই শামসুল হক সাকিব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ছেন। তাঁরা ছোটবেলা থেকে নাটক করতেন। তাঁদের মতে, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সংগঠন উগ্রপন্থা রোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
নিরাপত্তা ও বিধিবিধান
‘জঙ্গি হামলার আতঙ্ক না, পুলিশ রেইডের ভয়ে আছি।’ বললেন এক তরুণ। আরেকজন বললেন, যে কেউ যখন-তখন ‘জঙ্গি’ বলে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।
সাকিব-রাকিব দুই ভাই লালবাগে একটি মেসে উঠেছিলেন। পরে জানতে পারেন, গত মে মাসে পুলিশ সেখানে জঙ্গির খোঁজে হানা দিয়েছিল। তাঁরা এখন একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে থাকছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ডের ছাত্র মাশায়েল আজিমপুরে মেসে থাকেন। বললেন, ‘আজকে বাড়ি থেকে ফোন করে বলেছে চাচার বাসায় চলে যাও।’ ঈদের আগে যশোরে তাঁরা নয়জন বন্ধু মিলে আড্ডা দেওয়ার সময় পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলছেন, গুলশানে হামলার পর থেকে এলাকায় ঢোকার মুখে তল্লাশির কড়াকড়ি বেড়ে গেছে। তিনি হিজাব পরেন। তাঁর মনে হয়েছে, তল্লাশিকারীরা তাঁর দিকে ‘অন্য রকমভাবে’ তাকান। এদিকে মাদ্রাসার ছাত্র জুবায়ের বলছিলেন, নিরাপত্তা সবল করতে হবে। তবে উল্টোপাল্টা হয়রানি যেন করা না হয়।
ছাত্রলীগ গত ২০ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এতে নতুন ঝুঁকি দেখছেন। তাঁরা বলেছেন, দলীয় রাজনীতির চর্চা নয়, বরং ছাত্রদের অধিকার নিয়ে ছাত্র সংসদ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
নজরদারিতে বন্ধুত্ব
ধানমন্ডির আড্ডায় রাকিব বলেছিলেন, ‘যে ঘটনাগুলো দেখেছি, সেখানে তো ওরা (হামলাকারী) বন্ধুদের সাথে মিশেছে, আড্ডা দিয়েছে। কিন্তু ওরা তো কখনো ভাবেনি যে চেনাজানা বন্ধুটা জঙ্গি হয়ে যাবে।’
মিরপুরের একটি সরকারি কলেজে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র সজীব কাজী বললেন, ‘রাতে বাসায় ফিরলে বাবা-মা বলে এত ফ্রেন্ড রাখবি না।’
১৩ জুলাই টিএসসিতে চার বন্ধু বলছিলেন, তাঁরা আইএসের সমর্থক সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচিত ছাত্রকে চোখে চোখে রাখছেন। এ ছাড়া তাঁরা আরেকটি ছাত্রের ফেসবুক আইডি র্যাবকে পাঠিয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখার সময় এই ছাত্রের ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টে চরম ধারার পোস্ট দেখা গেছে।
বেশ কয়েকজন বলেছেন, কোনো বন্ধু খারাপ বা আপত্তিকর কাজে ঝুঁকলে আগে তাঁরা নিজেরা তাঁকে বোঝাতেন। এমনকি তাঁর পরিবারকেও জানাতেন না। কিন্তু এখন অনেকে ভাবছেন, সন্দেহ হলে পরিবারকে আর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়াই ভালো। সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ভয় ঢুকে পড়ছে বন্ধুত্বেরজগতে।
কেন উগ্র পথে
কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই বলেছেন, যাদের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল, তাদের এ পথে আকৃষ্ট করা সহজ। পরিবারের অবহেলার অভিযোগ এসেছে। আর তাঁরা দুষছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবকেও।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ) বিবিএ পড়ছেন রাজু তালুকদার। তিনি বললেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা সমাজ ও দেশ সম্পর্কে তেমন জানে না। তারা শুধু ইন্টারনেটেই ডুবে থাকে। এরা ধর্মের বিষয়গুলোও কম জানে। তাই তাদের সহজেই ভয় ও লোভ দেখানো যায়।’
শামীমার মতে, ফেসবুক বা টুইটারের পোস্ট অনুসরণ করে কারও মানসিকতা ও আদর্শ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ফলে তরুণদের লক্ষ্যবস্তু করা সহজ হচ্ছে।
একাধিক তরুণ অবশ্য বলেছেন, অনেকে সামাজিক মাধ্যমে নিজের মিথ্যা সত্তা তৈরি করে। এভাবে দ্বৈত-ব্যক্তিত্বের জন্ম হচ্ছে। তরুণেরা লোক দেখানো প্রচার-আচরণে ঝুঁকছে। আচরণে বিকৃতি আসছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সাঈদের মতে, ভিডিও গেমস খেলতে খেলতে মানুষ মারাটাও খেলার মতোই সহজ হয়ে যায়।
অনেকেই বলছেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা উগ্রবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে নতুনত্ব আর রোমাঞ্চের খোঁজে। আবার আরেকটি সাধারণ ধারণা হচ্ছে, হতাশায় ভোগা আত্মকেন্দ্রিক ছেলেমেয়েরা সহজ লক্ষ্যবস্তু।
হিযবুত তাহ্রীরের সমর্থক পরিচয় দিয়ে একজন শিক্ষার্থী অবশ্য বলেছেন, হতাশ ছেলেরা তাঁদের দলে খুব কম আসে। অধিকাংশ সদস্য আসে এমন পরিবার থেকে, যাদের মধ্যে ধর্মের চর্চা আছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছেন, যেসব শিক্ষকের কথায় শিক্ষার্থীরা বেশি প্রভাবিত হন, তাঁদের যেকোনো কথায় তাঁরা যা খুশি করতে পারেন।
বিশ্বের নানা জায়গায় মুসলিমদের নিগ্রহ তরুণদের ক্ষুব্ধ করে। নিজেদের পর্যবেক্ষণ থেকে বেশ কয়েকজন বলেছেন, উগ্রপন্থায় টানার একপর্যায়ে দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের কথা বলা হয়। গোড়াতেই দেওয়া হয় ফিলিস্তিনের উদাহরণ।
তরুণেরা অন্যায় আর বিশৃঙ্খলা দেখে ক্ষুব্ধ হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেছেন, যুগে যুগে আদর্শবাদী, স্বপ্নবিলাসী, প্রতিবাদী তরুণেরাই বিপ্লবে নামেন। সে রকম ছেলেমেয়েরা জঙ্গি হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে আছে।