এর আগের দিন ২৮ জুলাই মঠবাড়িয়া সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন ধূপতি গ্রামের জায়েদা খাতুন। জায়েদা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর গর্ভাবস্থার প্রায় ১০ মাস পূর্ণ হয়েছিল। কেন মৃত সন্তানের জন্ম হলো, তিনি জানেন না।
বাংলাদেশে নূরজাহান বা জায়েদার মতো মায়েরা প্রতিদিন ২২৭টি মৃত সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বছরে দেশে ৮৩ হাজারের বেশি মৃত জন্মের (স্টিলবার্থ) ঘটনা ঘটছে। তাঁদের অভিযোগ, মৃত জন্মের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর প্রতিকারে দৃশ্যমান কর্মসূচি নেই।
দক্ষিণের এই উপজেলা মঠবাড়িয়ার বেসরকারি মাতৃসদন ও স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাঈমা কবীর দেড় দশকের বেশি সময় এ অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রথম আলোকেবলেন, অনেক মা প্রসবপূর্ব সেবা (অ্যান্টিনেটাল কেয়ার) পাচ্ছেন না। কে ঝুঁকিপূর্ণ মা, তা মাঠপর্যায়ে শনাক্ত হচ্ছে না। এসব কারণে মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না।
শিশু যদি গর্ভে ২৮ সপ্তাহ বা তার বেশি থাকে, ওজন যদি এক হাজার গ্রাম বা তার বেশি হয় এবং যদি মৃত অবস্থায় জন্ম নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটি ‘মৃত জন্ম’। বাংলাদেশ এই সংজ্ঞাটি গ্রহণ করেছে।
পরিস্থিতি গুরুতর: এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট মৃত জন্মের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পাঁচটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করে। মৃত জন্ম বা স্টিলবার্থ বেশি এমন ১০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করে ল্যানসেট। তালিকার শীর্ষে আছে ভারত, পাকিস্তান ৩ নম্বরে। আর বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ৮৩ হাজার ১০০টি মৃত জন্ম হয়েছিল। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, সংখ্যাটি ৮৩ থেকে ৮৪ হাজারের মধ্যে।
ল্যানসেট-এর গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘সেভিং নিউ বর্ন লাইফ’ কর্মসূচির পরিচালক সাইদ রুবায়েত। তিনি বলেন, ১ হাজার জন্মের ঘটনায় ২৫টি মৃত শিশু জন্ম নিচ্ছে। এটা বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। মৃত শিশু জন্ম প্রতিরোধে অগ্রগতি সামান্যই।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত উন্নয়ন কর্মসূচির মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মপরিকল্পনার লাইন ডিরেক্টর হাবিব আবদুল্লাহ সোহেল প্রথম আলোকেবলেন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও মৃত জন্ম প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সাফল্য কম। তবে এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক। প্রসবপূর্ব মানসম্পন্ন সেবা ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে নবজাতকের স্বাস্থ্য বিষয়ে ‘এভরি নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান’ নামের একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। ওই পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ১ হাজার জন্মে মৃত শিশুর সংখ্যা ১২ বা তার নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে এখনই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
গুরুত্ব নেই: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলধারার স্বাস্থ্য আলোচনায় বা কর্মসূচিতে মৃত শিশু জন্মের বিষয়টি উপেক্ষিত। এর একটি কারণ মৃত জন্মের অধিকাংশ ঘটনা ঘটে বাড়িতে। সরকারি ব্যবস্থায় মৃত শিশুর জন্মের হিসাব রাখা হয় না।
কয়েকটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ তুলে ধরে সাইদ রুবায়েত বলেন, বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। প্রতি তিন বছর পর পর অনেক বড় আয়োজনের মধ্য দিয়ে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ করা হয়। গ্রহণযোগ্য এই জরিপের তথ্য দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়। অথচ সেই জরিপেও মৃত জন্মের পরিসংখ্যান যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না। দ্বিতীয়ত, চলমান পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১১-২০১৬) স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচিতে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও বরাদ্দ নেই। এমনকি আগামী স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচি (২০১৭-২০২২) দলিলে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়নি।
মৃত জন্মের প্রভাব: মৃত সন্তান জন্মের বিরূপ প্রভাব পড়ে মা-বাবা ও পরিবারের ওপর। অনেক ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভোগেন মৃত সন্তান জন্ম দেওয়া মা। সমাজও অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয় না।
সাইদ রুবায়েত বলেন, গবেষণায় মৃত জন্মের সঙ্গে দোষারোপের সংস্কৃতির কিছু সম্পর্ক পাওয়া যায়। দোষ দেওয়া হয় মাকে, বলা হয় এটা মায়ের সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ হয়, পারিবারিক প্রীতি নষ্ট হয়। অন্যদিকে নতুন কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। শোক ভুলতে বা বদনাম ঘোচাতে খুব শিগগির আরেকটি সন্তান নেওয়ার উদ্যোগ নেন মা অথবা ওই দম্পতি। শরীর পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই এই উদ্যোগ মা ও পরবর্তী সময়ে নবজাতকের স্বাস্থ্য দুর্বল করে। এ ছাড়া মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অনেক মায়ের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
মৃত শিশু জন্মের কারণ: গবেষক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ভ্রূণের বাধাগ্রস্ত বিকাশ বা সময়ের আগে প্রসব হলে মৃত জন্মের আশঙ্কা থাকে। ল্যানসেট-এর দ্বিতীয় প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৪ শতাংশ মৃত জন্মের কারণ দীর্ঘায়িত গর্ভধারণ। গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ (ম্যালেরিয়া বা সিফিলিস), পুষ্টি পরিস্থিতি, জীবনযাপন প্রণালি, অসংক্রামক ব্যাধিতে (ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ) আক্রান্ত হলে মৃত জন্মের হার বাড়ে। গবেষকেরা বলছেন, মায়ের বয়স খুব কম বা বেশি হলেও মৃত জন্মের ঝুঁকি বাড়ে। ডা. নাঈমা কবীর জানান, নূরজাহানের বয়স অনেক কম ছিল।
নাঈমা কবীর বলেন, রক্তচাপ ও রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ—এই দুটো বিষয় জানতে পারলেই ঝুঁকি অনেক কমানো যায়। কিন্তু বিপুলসংখ্যক মা গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় আসছেন না।
তাঁর বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় সরকারি পরিসংখ্যানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রসবের পূর্বে গর্ভধারণকালে প্রসূতির কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস ২০১৪) বলছে, মাত্র ৩১ শতাংশ প্রসূতি এই সেবা পান। গ্রামে বা দরিদ্র ও নিরক্ষর পরিবারে এই হার আরও কম।
পরিস্থিতির উন্নয়নে করণীয়: ধূপতি গ্রামের জায়েদা প্রথম আলোকে বলেছেন, গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তিনি একবারও কোনো চিকিৎসকের কাছে যাননি। সরকারি বা এনজিও মাঠকর্মীর কাছ থেকেও প্রসবপূর্ব সেবা পাননি।
এ ব্যাপারে পেশাজীবী সংগঠন অবসট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক লতিফা শামসুদ্দিন প্রথম আলোকেবলেন, মৃত শিশু জন্ম কমাতে প্রসবপূর্ব সেবার ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। মানসম্পন্ন সেবার আওতায় সব গর্ভবতী মহিলাকে আনতে হবে। এ ছাড়া প্রসব পরিকল্পনার বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। কোথায় কার কাছে প্রসব হবে, এটা আগে নির্ধারণ করা গেলে মৃত জন্মের পরিমাণ কমে যাবে।
প্রতিরোধের ব্যাপারে ল্যানসেট বলেছে, মৃত জন্মের তথ্য-উপাত্তের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। পরিবার, বিশেষ করে নারীর ওপর যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে, তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি হাতে নিতে হবে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করতে হবে।