ভার্চুয়াল জগতের প্রভাব বাড়ছে রাজনীতিতে। তরুণ প্রজন্ম ব্যাপকভাবে সাইবার নির্ভর হচ্ছে। নানা মাধ্যমের মধ্যে ফেসবুকের ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করছে। কিন্তু, এর খারাপ দিকও আছে। এর কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে যেতে পারে। সামাজিক গণমাধ্যমে ঐক্যের চেয়ে বিভেদ বেশি ছড়ায়- বলছেন বিদেশি গবেষকরা। দক্ষিণের উপজেলা মঠবাড়িয়া থেকে ঢাকায় এসেছিলেন চার যুবক। তারা স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দলের রাজনীতিতে সক্রিয়। ঢাকার এক নেতার সঙ্গে দলীয় কাজে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা আড্ডা দিচ্ছিলেন একটি চায়ের দোকানে। দেখা গেল, তাদের আড্ডার প্রায় সব কথাই ফেসবুককে ঘিরে। জানা গেল, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই আছে ফেসবুক আইডি। তারা ফেসবুক ব্যবহার করেন সবসময়। তাদের হাতে আছে স্মার্ট ফোন। তাদেরই একজন সাইফুল্লাহ। জানালেন, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি কর্মীদের কে কোথায় আছে। কেউ কারও ওপর ক্ষুব্ধ হলে সে স্ট্যাটাস দেয় ফেসবুকে। দলের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি হলেও তর্কের ঝড় ওঠে ফেসবুকে। একে অন্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে ফেসবুকেই। লাইক আর কমেন্ট দেখেই বুঝতে পারি কে কোন গ্রুপের পক্ষে। আরেকজনের নাম ইস্রাফিল। ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি সকল কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বলছেন, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ অনেক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকে অনুসরণ করছি আমি। তারা যখন যে তথ্য দিচ্ছেন ফেসবুকে আমি সঙ্গে সঙ্গে তা শেয়ার করে দিচ্ছি বন্ধুদের মধ্যে। ফেবসুকে আমার বন্ধুর সংখ্যা দেড় হাজার। এদের মধ্যে সরকারি ও বিরোধী দলের লোক আছে। কর্মী ও নেতারা আছে। আমাদের দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপের লোকও আছে। শিবির কর্মীও ছিল একজন। তাকে ব্লক করে দিয়েছি। দেখা গেল চায়ের দোকানের আড্ডায় রাজনীতি এখনও আছে ঠিকই, তবে তাতে ফেসবুকের প্রভাব পড়েছে। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একটি দোকানের ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান। তিনি কথা বলছিলেন রাজনীতি নিয়ে। জানালেন, এখন আর খবরের কাগজ পড়েন না। টিভিও তেমন একটা দেখেন না। সারা বিশ্বের রাজনীতির খবর পান ফেসবুক থেকে। এখন কথাবর্তায় নানা তথ্য দেয়ার আগে বলেন, ‘ফেসবুকে দেখলাম’। সত্য-মিথ্যা যেখানে যা পান তিনি তা বিশ্বাস করেন। শহরের রাজনীতিতে সাইবারের এই প্রভাব আরো বেশি। ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির ছবি-বক্তব্য-ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউবে। সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছে যাচ্ছে অনেক চেনা-অচেনা লোকের কাছে। অনেকে সরাসরি কোনো কর্মসূচিতে না গেলেও সক্রিয় সোশাল মিডিয়ায়। এসব বিষয়ে পশ্চিমা দেশের গবেষকদের অনেক গবেষণা থাকলেও বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গবেষণা দেখা যায়নি। লিডারশিপ কনফারেন্স নামের আমেরিকাভিত্তিক একটি নাগরিক অধিকার সংস্থা তাদের গবেষণায় দাবি করেছে, সামাজিক গণমাধ্যমে মূলত ভালোর চেয়ে মন্দের প্রচার হয় বেশি। সীমাহীন ঘৃণা ছড়ানো যায় মুহূর্তের মধ্যে। চাইনিজ গবেষক ওয়াং ইউক সামাজিক গণমাধ্যমকে বলেছেন মূলত ‘অসামাজিক’ মাধ্যম। তিনি বলেছেন, এতে মানুষ মত প্রকাশ করে নিরাকার শ্রোতার সঙ্গে। ফলে, বিদ্বেষ আর ঘৃণার রসদ সরবরাহ করা সহজ হয়। গবেষকরা বলছেন, সামাজিক গণমাধ্যমে সাধারণত মানুষ নিজের মতের প্রশংসা দেখতে চায়। সমালোচনা বা বিরোধিতা সহ্য করে না। যখনই কেউ বিরোধিতা করে তখন তীব্র তর্ক আর ঘৃণার আদান প্রদান হতে থাকে। সামনাসামনি যেসব অশ্রাব্য গালাগালি দেয়া না যায়, সামাজিক মাধ্যমে তা-ই দেয়া হয়। রাজনীতিতে সেই সব চর্চা বেড়ে যাওয়াকে হুমকির বিষয় মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার সোশাল মিডিয়ার কারণে রাজনীতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গণসংযোগ সহজ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক নেতা সোশাল মিডিয়ায় সক্রিয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টুইটার কূটনীতির প্রভাবের কথাও গবেষকরা স্বীকার করছেন। সেদিক থেকে অবশ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং বিএনপি নেত্রীসহ কেউই সামাজিক মাধ্যমে তেমন সক্রিয় নন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, সামাজিক গণমাধ্যম একটা ‘নতুন মিডিয়া’। মালিকপক্ষের নীতি, বিদ্যমান আইন অথবা গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেক বিষয় মূলধারার গণমাধ্যম প্রচার করে না। কিন্তু, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বাধ্যবাধকতা না থাকায় তারা অনেক তথ্য প্রচার করছে। এটা একদিকে মূল ধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে এটা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর খবরের জন্য অন্যতম সোর্স হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমের এই গবেষক আরো বলেন, সোশাল মিডিয়ার কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই। এটা রাষ্ট্রীয় সীমানার গতানুগতিক ধারণাকে বদলে দিয়েছে। এক দেশের বিষয়ে অন্য দেশের মানুষ মত প্রকাশ করতে পারছে। এক দেশের ইস্যুতে অন্য দেশের নাগরিকরা ক্যাম্পেইনও করছে। আবার বিভিন্ন বিষয়ে প্রবাসী নাগরিকরা বা প্রবাসী বিশেষজ্ঞরাও মতামত দিতে পারছে। তবে, দুঃখজনকভাবে অনেকে একে খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। সামাজিক গণমাধ্যমের সৃজনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যবহারকারীদের এসব বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এই শিক্ষক।