মাঝে মাঝে কিছু সময় আসে যখন কিছু গুরুতর সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয় আমাদেরকে । ধরুন একজন নারী সন্তান জন্মদানের সংকটাপন্ন মুহূর্তে ডাক্তার বললেন , হয় মা নয়তো বাচ্চাকে বাঁচাতে পারবেন । তখন অনেকটাই বিব্রত হয়ে যান অভিভাবকটি কাকে বাঁচাবেন মাকে নাকি সন্তানকে ? কষ্টের টানাপোড়ন পেরিয়ে একসময় একটি জটিল সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয় , বাচ্চা নয় বরং মাকেই বাঁচাতে হবে । কারন মা বাঁচলে ভবিষ্যতে আবারো সন্তান জন্ম দিতে পারবেন ।
রামপালে বহুল আলোচিত কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আজ আমাদের কাছে সন্তান আর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন আমাদের কাছে মায়ের মতই । কারন মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে তেমনি প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে সব সময় আগলে রাখে এই সুন্দরবন । এ বনটি আমাদের কাছে বিশাল এক রক্ষাবর্ম । তাই মাকে হত্যা করে কোন সন্তান আমরা চাইনা ।
জীব বৈচিত্রে ভরপুর এ বনটি আমাদের পরিবেশকে নানাভাবে রক্ষা করছে । ঝড় , জলোচ্ছাস , সাইক্লোন , ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করছে আমাদের এ বনটি । পাশাপাশি কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান বাহক হিসাবে ও কাজ করছে । সরকার সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাতে চাইছে । কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে পড়বে । ইতিমধ্যে বনদস্যু আর অসাধু মানুষের অদৃশ্য হাতের স্পৃশে এমনিতেই এর সৈন্দর্যহানী অনেকখানি হয়েছে ।
সরকারী পরিবেশ সমীক্ষা ইআরএ অনুযায়ী , রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা ইন্দোনেশিয়া , অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিন আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানী করতে হবে । আমদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জাহাজের মাধম্যে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে । কিন্তু সুন্দরবনের ভিতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারনে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দর বনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে । এর জন্য সুন্দর বনের ভিতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিঃমিঃ নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৭ কিঃ মিঃ পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে ।
যতদূর জানা যায় , এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ২২শ পরিবারকে জমি ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে স্থানীয়ভাবে । ইতিমধ্যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের নির্ধারিত জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ ও হয়েছে । সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে পশুর নদীর তীর ঘেঁষে এই প্রকল্পে ১৮৩৪ জমির সীমানা চিহিৃত করা হয়েছে । ওসধমব ঈধঢ়ঃরড়হ পশুর নদীতে এ ধরণের বহু ড্রেজার দিয়ে বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে প্রকল্প এলাকা । যার প্রথম পর্যায়ে ডিসেম্বরের মধ্যে ৪২০ একর এলাকারয় মাটি ভরাটের টার্গেট রাখা হয়েছে ।
কথা হচ্ছে সুন্দরবন একটি শ্বাসমূলীয় জলাবন অর্থাৎ মানগ্রোভ । পরিবেশবিদগন মনে করছেন , রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে , তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ক্ষতিকারক নানা পদার্থ নির্গমনে ক্ষতি হবে । এর ফলে একই সঙ্গে বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার , হরিণ , কুমিরসহ নানা প্রজাতির জীবন বিপন্ন হবে । এর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে বনের গাছগাছালি, পশুপাখি , মাছসহ সব ধরনের জীববৈচিত্রের উপর । বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি , কয়লা , পোাড়নো ছাই ও কালো ধোঁয়া সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ধ্বংস করবে । বন ধ্বংস হলে শুধু আমরা নয় , সমগ্র বিশ্ব চিরদিনের মতো অমূল্য সম্পদটি হারাবে । ধ্বংস হবে সুন্দরবনের স্বাভাবিক পরিবেশ ।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন , রামপাল প্রকল্পের দূষনে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে থাকা নিবিড় সুন্দরবন পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে । রামপালের ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়া ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড , ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই অক্্রাইড , ২ হাজার ৬০০ টন ছাই সুন্দরবনের নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসবে । পাশাপাশি এ প্রকল্প কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৭ লাখ টন কয়লা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের মধ্য দিয়েই পরিবহন করার ফলে লাখ টনি ক্যারিয়ার আর হাজার টনি লাইটারেজ জাহাজের আনাগোনা , তীব্র শব্দ , জাহাজ থেকে চুইয়ে পড়া তেল , কয়লার ভাঙ্গা অংশ , জাহাজ চলাচলের প্রচন্ড ঢেউ সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে ।
বিশেষজ্ঞরা আরো মনে করেন , কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড , সালফার ডাই অক্সাইড , নাইট্রাস অক্সাইড , বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা , মারকারি বা পারদ , আর্সেনিক , শেলেনিয়ামসহ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয় । পাশাপাশি কয়লা পুড়ে তৈরী হয় ছাই । আর কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য কোল স্লাজ বা তরল কয়লা বর্জ্য । ছাই ও স্লাজ উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারন এতে আর্সোনিক , মার্কারি বা পারদ , ক্রোমিয়াম এমনি তেজষ্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে । এতে মানবদেহের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি ক্ষতি হয় বন্য প্রানীরও ও । ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য সন্দুরবনের জীববৈচিত্র্যসহ এলাকার মানুষের কৃষি ও স্বাস্থ্য ঝুঁজি বাড়বে । ক্ষতিগ্রস্থ হবে সবুজ বেষ্টনী । পাশাপাশি কয়লা পরিবহন কারী জাহাজ থেকে কয়লা লোড আনলোড করার যন্ত্রাপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দ দূষন ও জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রানী সহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু পাখির জীবনচক্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে । তাই সুন্দরবন রক্ষার দাবী এখন গনমানুষের প্রানের দাবী ।
সম্যক ধারনা থেকে বলা যেতে পারে , সরকার সুন্দরবনের সন্নিকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত । বুঝতে পারছি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ফলে অত্র এলাকাসহ দেশী বিদেশী কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে । কিন্তু প্রকৃতি যদি বিরুপ হয় , পরিবেশ যদি বিপন্ন হয় , পরিবেশ যদি মানুষ ও পশুপাখির বাঁচার জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায় তাহলে এমন উন্নয়ন নিশ্চই কেউ চাইবে না । তাই রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন শুধু রাজনৈতিকভাবে বির্তকিত নয় বরং প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের পাশাপাশি গনমানুষের দাবী হয়ে উঠেছে । এ দাবী বিদ্যুৎকেন্দ্রর বিরুদ্ধে নয় , বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরুদ্ধে নয় , বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপানের বিরুদ্ধে নয় , প্রকল্পের বিরুদ্ধে নয় , উন্নয়নের বিরুদ্ধে নয় , সরকারের রিরুদ্ধে নয় , বিনিয়োগকারী কোম্পানীর বিরুদ্ধে নয় এমনি ভারতের বিরুদ্ধেও নয় । এ দাবী জাতীয় স্বার্থরক্ষার ।
সুন্দরবন আমাদের সম্পদ । আমরা দেশের উন্নয়ন বিরোধী না । সংবিধানের ৭ এ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের একজন মালিক বটে । আমরা এই দেশকে এমনভাবে সাজাতে যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটি দূষণমুক্ত পরিবেশ বান্ধব পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে । বিদ্যুৎ আমরা চাই কারন বিদ্যুৎ ছাড়া কোন দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় । তাই বলে পরিবেশের উপর আঘাত হেনে নয় । জীববৈচিত্রকে ধ্বংস করে নয় । সুন্দরবন আমাদের অহংকার । অহংকার রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিরল প্রজাতির ডলফিন গাঙ্গেয় ও ইরবতী । আশা করবো সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে । বিদ্যুৎকেন্দ্র এদেশের মাটিতে হোক তবে তা সুন্দরবন বা তার আশেপাশে নয় বরং অন্যকোথাও ——————
হাসি ইকবাল
কবি , প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার