পরবর্তী বড় প্রকল্প গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ

Slider জাতীয়

cd93cc49faf8ed78c70bea6476a1defd-gorai-river

দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত গঙ্গা বাঁধ নির্মাণকে অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকাভুক্ত করেছে সরকার। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর এর নকশাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের পরবর্তী বড় প্রকল্প হবে গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রকল্পের কারিগরি ও আর্থিক বিষয় নিয়ে আলোচনা ও কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ফলাফল ও তথ্যাদি ভারতের সঙ্গে বিনিময় করা হয়েছে। গঙ্গা বাঁধ প্রকল্পে সরকার ভারতের অংশগ্রহণ আশা করে। সরকার চায়, গঙ্গা বাঁধ প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার একটি দৃশ্যমান প্রতীক হয়ে থাকুক।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি সরকার অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার; একই সঙ্গে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত গঙ্গা চুক্তিরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে প্রকল্পের কারিগরি, অর্থায়নসহ সার্বিক বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। প্রকল্পের নকশাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি একটি বড় প্রকল্প। তাই তাড়াহুড়া করে কিছু করা যাবে না। ভারতের সঙ্গে প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য বিনিময় হচ্ছে। সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ চায়।
ভারত-বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অভিন্ন নদী গঙ্গা-পদ্মায় শুকনো মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে। এতে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় ভারত আশির দশকেই বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছিল গঙ্গা বাঁধ নির্মাণের। এই কাজে সম্ভাব্য সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছিল ভারত।
এরপরই সরকার গঙ্গা বাঁধ প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কার্যক্রম তেমন এগোয়নি। গত বছর সরকার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে। রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই বাঁধ নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা (৪০০ কোটি মার্কিন ডলার)। বিশ্ব ব্যাংক, চীন ও জাপান এই প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে।
এই বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গার পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ব্যবহার করা হবে। পানির আধার হবে গঙ্গানির্ভর নদীগুলো। অর্থাৎ, ধরে রাখা পানি কোথাও নদীর কূল ছাপিয়ে যাবে না। শুধু শুকনো মৌসুমে যে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যেত, সেগুলো ধরে রাখা পানিতে ভরা থাকবে।
সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পানি দিয়ে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পাবনা ও রাজশাহী জেলার প্রায় ১৯ লাখ হেক্টর কৃষিজমিতে সেচ নিশ্চিত হবে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে বছরে প্রায় ২৬ লাখ মেট্রিক টন। গড়াই, নবগঙ্গা, বড়াল, কপোতাক্ষসহ গঙ্গানির্ভর নদীগুলোতে পানির প্রবাহ ও নাব্যতা বাড়বে। মাছ উৎপাদন বাড়বে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন। সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অতিরিক্ত লবণাক্ততা সুন্দরবনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে ও ওই অঞ্চলে মিঠা পানির যে অভাব দেখা দিয়েছে, ক্রমান্বয়ে তারও নিরসন হবে। নিরসন হবে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মরুকরণ প্রবণতারও।
এই বাঁধের পানি ব্যবহার করে প্রায় ১২৫ মেগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্দেশীয় নৌ চলাচল বাড়বে। বাঁধের ওপর নির্মিত হবে চার লেনের সড়ক, যা দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ নিবিড় করবে। এই সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঁধ ও আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় উঠে আসবে।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যেকার যৌথ ঘোষণায়ও গঙ্গা বাঁধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেখানে এই বাঁধ নির্মাণে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি জানাবেন বলে তখন বলেছিলেন।
প্রকল্পটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, গঙ্গার পানির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঁধ নির্মাণই বাংলাদেশের জন্য একমাত্র পথ। সরকারের উচিত অগ্রাধিকার দিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি ব্যবহারে এই বাঁধের কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক নিশাত বলেন, ভারত শুরু থেকেই বাঁধ নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানির সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার কথা বলে এসেছে। ইতিমধ্যে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তির ১৮ বছর চলে গেছে। চুক্তির এই মেয়াদ শেষে ভারত নিশ্চয়ই আবার গঙ্গার পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের প্রশ্ন তুলবে। তখন বাংলাদেশের কোনো যৌক্তিক অবস্থান নেওয়ার থাকবে না।
১৯৭৫ সালে ভারত পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ নির্মাণ করে। এর মাধ্যমে গঙ্গার প্রবাহ থেকে ৪০ হাজার কিউসেক (প্রতি সেকেন্ডে ৪০ হাজার ঘনমিটার) পানি নিয়ে ভাগীরথী ও হুগলী নদীতে প্রবাহিত করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে শুকনো মৌসুমে পদ্মায় পানির প্রাপ্যতা কমতে থাকে। এর পরবর্তী সময়ে উজানে জনসংখ্যা, চাষাবাদ, শিল্পকারখানাসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মায় গঙ্গার পানির প্রাপ্যতা আরও কমে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই চিত্র দাঁড়ায় সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন বিপুল পরিমাণ পানি চলে যায় সমুদ্রে। এই পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বাঁধ নির্মাণ অপরিহার্য।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমানে জ্যেষ্ঠ পানিসম্পদ প্রকৌশলী হিসেবে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ে (আইডব্লিউএম) কর্মরত) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে গড়াইসহ পদ্মার উভয় তীরের শাখানদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়াতে হলে গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ অপরিহার্য। বর্ষা মৌসুমে গঙ্গা-পদ্মায় পানির প্রবাহ থাকে প্রায় ৭০ হাজার কিউসেক। শীতকালে তা কমতে কমতে এখন ৯০০ কিউসেকে এসে দাঁড়ায়। কাজেই বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বাঁধ নির্মাণ ছাড়া কোনো উপায় নেই। গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ করে বিপুল পরিমাণ পানি ধরে রেখে তা শুকনো মৌসুমে ব্যবহারের মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *