দলীয় সাংসদদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর বিএনপিও নড়েচড়ে বসেছে। দলটির আশঙ্কা, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে সরকার আগাম নির্বাচন দিতে পারে। এতে বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচনের অযোগ্য হতে পারেন।
দলটির উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, নিজেদের সুবিধামতো সময়ে আগাম নির্বাচন করার সরকারি চিন্তার কিছু ইঙ্গিত তাঁরা পেয়েছেন। তাঁদের কাছে খবর আছে, ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সরকারের শরিক জাতীয় পার্টিকেও (জাপা) নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ গত ১৮ জুন চার দিনের ভারত সফরে যান। এ সফরে এরশাদ দেশটির রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, জাপাকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার তাগাদা দিয়ে জানানো হয়, আগামী বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ একটি সেমিনারে অংশ নিতে গত সপ্তাহে নয়াদিল্লি গেছেন। ২৬ জুলাই ‘মৌলবাদের উত্থান: দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নিরাপত্তা’বিষয়ক এ সেমিনার হয়। আজ তাঁর দেশে ফেরার কথা। এ সফর নিয়েও দলে নানা কথা আছে।
বিএনপির নেতাদের অযোগ্য করে নির্বাচনের চিন্তাকে জনগণের ওপর সরকারের আস্থাহীনতা বলে মন্তব্য করেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার জনগণের ওপর আস্থা পাচ্ছে না। তাই এসব তাদের বিকল্প চেষ্টা। এর মাধ্যমে তারা টিকে থাকতে চাইছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, দুটি কারণে তাঁরা সরকারের আরেকটি ‘প্রহসনমূলক’ মধ্যবর্তী নির্বাচনের আশঙ্কা করছেন। প্রথমত, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলাগুলোতে সরকারের তাড়াহুড়া। দ্বিতীয়ত, গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় দলীয় সাংসদদের এখন থেকেই জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁরা যেসব তথ্য পাচ্ছেন, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একটা যোগসূত্র বা মিল আছে। এ কারণে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে এবং তারও আগে ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশবিষয়ক সেমিনারেও বিষয়টি তুলেছিল বিএনপি।
কূটনীতিকদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা কূটনীতিকদের বলেছি, সরকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সাজা দিয়ে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রহসন করার অপচেষ্টা করছে। বলেছি, এতে বিরাজমান সমস্যা দূর তো হবেই না, বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।’
আর যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের সেমিনারে বিষয়টি উত্থাপনের কথা উল্লেখ করে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। হাউস অব কমন্সের সেমিনারেও বিষয়টি উঠেছিল। যতটুকু জানি, সেখানে এর প্রতিক্রিয়া ভালো হয়নি। এ ধরনের নির্বাচন হলে তা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।’
দলীয় সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় গত সপ্তাহে তারেক রহমানকে সাত বছরের সাজা ও ২০ কোটি টাকা জরিমানার রায়ের পর বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে তারেকের দেশে ফেরা ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। একই অবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে খালেদা জিয়ার ব্যাপারেও। দলের নেতারা ইতিমধ্যে সভা-সেমিনারে তা বলেছেন।
বিএনপি ও আদালত সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২৯টি মামলা আছে। এর মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাঁচটি; হত্যা, বিস্ফোরক ও নাশকতার অভিযোগে ১৫টি; মানহানি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, রাষ্ট্রদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ মিলিয়ে মামলার সংখ্যা এই।
জানা গেছে, দুদকের মামলাগুলো হয়েছে সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সেগুলো হলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি, নাইকো দুর্নীতি, গ্যাটকো দুর্নীতি ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতির মামলা। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে এখন খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থন করার পর্যায়ে আছে।
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত খালেদা জিয়াসহ বিএনপির ১৫৮ জন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৩৩১টি মামলা ছিল। আর সারা দেশে নেতা-কর্মীদের নামে মামলা ছিল ২১ হাজার ৬৮০টি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা আছে। ২৫টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৮৩টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৩, মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা আছে। এ ছাড়া গত বছরের ২ অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার ৩০টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ২১, তরিকুল ইসলাম ১২, আ স ম হান্নান শাহ ১০ ও খন্দকার মোশাররফ হোসেন ৬টি মামলার আসামি ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের জেল দিয়ে তারা আবার নির্বাচন করে ক্ষমতায় পুনর্বহাল থাকতে চায়। আমরা দেখছি, সরকার আমাদের মামলায় খুব তাড়াহুড়া করছে। ৫ থেকে ১০ দিনের বেশি সময় দেওয়া হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের মামলায় এক-দেড় মাস পর পর তারিখ দেওয়া হয়।’
বিএনপির নেতারা বলছেন, দুর্নীতির মামলায় সাজার পর খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়ে দলের একটি অংশকে হাত করে সরকার নির্বাচন করবে, এমন গুঞ্জন অনেক দিন ধরেই দলের ভেতরে-বাইরে আছে। তারেকের সাজার রায়ের পর ওই গুঞ্জন আরও ঘণীভূত হচ্ছে বলে নেতাদের আশঙ্কা।
এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বেগম জিয়াকেও সাজা দেওয়া হবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারা (সরকার) যদি এমনটা করতে যায়, তার প্রতিক্রিয়া ২০১৪ সালের চেয়ে ভিন্ন রকম হবে।’