তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর নানা রকমের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এক নম্বর প্রশ্ন, এ রকম একটা ঝানু সেনাবাহিনী এমন আধা খাস্তা অভ্যুত্থান করতে গিয়েছিল কী ভেবে? আসলেই কি এই অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল এরদোয়ান সরকারের পতন ঘটানো? নাকি তাঁকে আরও শক্তিশালী করা এবং তুর্কি সেনাবাহিনীর মধ্যকার ‘প্রগতিশীল’ ও ‘অমৌলবাদী’ অংশটিকে ঝেড়ে ফেলা?
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টার মূল হোতা হিসেবে যে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছেন, ফেতুল্লাহ গুলেন নামের সেই তুর্কি ভিন্নমতাবলম্বী ইমাম বসবাস করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায়। এরদোয়ানের অভিযোগ অনুযায়ী, তুর্কি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে তাঁদের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের প্ররোচনা এসেছে প্রেসিডেন্ট ওবামার দেশ থেকে। লন্ডনের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে, তুরস্ক সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সে দেশে ব্যর্থ অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টার জন্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেই দায়ী করেছেন। ওবামা প্রশাসন জোরালো ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে টেলিফোনে বলেছেন, ‘(তুরস্কে) ব্যর্থ অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টার ব্যাপারে (যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে) প্রকাশ্যে আভাস-ইঙ্গিত করা বা তার কোনো ভূমিকা ছিল বলে দাবি করা একদম মিথ্যা, এবং আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।’
ফেতুল্লাহ গুলেন এরদোয়ানের এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রতি তাঁর সমর্থন নেই এবং তুরস্কের এই অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ফোন করে গুলেনকে গ্রেপ্তার করে তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাতে রাজি হয়নি।
তুর্কি-মার্কিন সম্পর্কের এই নতুন টানাপোড়েন বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে দুটি ঘটনা থেকে।
এক. প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে টেলিফোন করেছেন, আর পুতিন তাঁকে বলেছেন, রাশিয়া তুরস্কের নির্বাচিত সরকারের পাশে রয়েছে। এই সুযোগে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের চলমান টানাপোড়েন কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটা ঘটলে সম্ভবত কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার একটু সুবিধা হবে, সিরিয়ায়ও তার কিছু প্রভাব পড়তে পারে।
দুই. প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুরস্কের দক্ষিণে ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তুর্কি সরকার বলেছে, তুর্কি সামরিক বাহিনীর যে অংশটি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে উৎখাত করতে চেয়েছিল, তাদের কয়েকজন ছিল ওই বিমানঘাঁটিতে। তারা সেখান থেকে যুদ্ধবিমান উড়িয়েছিল।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, তুরস্কের ইনজিরলিক বিমানঘাঁটিটি নির্মাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক কৌশলগত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। ১৯৫৪ সালে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির বলে যুক্তরাষ্ট্র এই বিমানঘাঁ ব্যবহার করে আসছে সেই ১৯৫৫ সাল থেকে। তারা সেখানে ২১টি ভল্টে ৫০টি বি৬ ওয়ান পারমাণবিক বোমা মোতায়েন করে রেখেছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে, পুরো ইউরোপের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বোমার ভান্ডার। এগুলো সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের কালে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পরেও সরিয়ে নেওয়া হয়নি।
যা হোক, তুরস্ক ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে যে অসুবিধায় পড়েছে, তা রাশিয়াকেন্দ্রিক নয়, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। ওই বিমানঘাঁটি থেকে সিরিয়ার আলেপ্পো-রাকা সীমান্ত মাত্র ৬৮ মাইল দূরে, যেখানে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা এক ‘খিলাফত’ রাষ্ট্রের পত্তন ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা দুনিয়ায় রক্তপাত ঘটাচ্ছে আর ত্রাস ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে, কিছুদিন হলো যুক্তরাষ্ট্র ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে সিরিয়ায় আইএস যোদ্ধাদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। এখন এই বিমানঘাঁটি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র আর সেটা করতে পারছে না। ফলে তুরস্কের এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা সিরিয়ায় আইএস দমনের সামরিক অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছে, চলো, আমরা এবার যৌথভাবে আইএসকে ধ্বংস করে ফেলি। রাশিয়া অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে এই প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া-ইরাকে আইএসকে ধ্বংস করতে তত আগ্রহী ছিল না, যতটা আগ্রহী ছিল সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাত করতে। কিন্তু বাশার আসাদ তো মধ্যপ্রাচ্যে পুতিনের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আইএস ও অন্যান্য বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর বহুমুখী আক্রমণের মুখে বাশারকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তো পুতিন সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছেন। এখন আইএসকে যৌথভাবে ধ্বংস করার যে প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে দিল, তাতে রাশিয়ার রাজি হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে তার আগের অবস্থান থেকে সরতে হবে। তাকে মেনে নিতে হবে যে সে আর বাশার সরকারের পতন চাইবে না।
তুরস্ক ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য এবং রাশিয়ার নিকট প্রতিবেশী। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ও ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের আড়াই দশক পরেও সোভিয়েতের সামরিক উত্তরাধিকার বহনকারী রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো জোটের সম্পর্ক দ্বন্দ্বমুখর রয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্বে ন্যাটোর তরফে তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বিরাট। সেই তুরস্কের সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের নাজুকতা দৃশ্যমান হলো এই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার ফলে যদিও বাইরে থেকে মনে হচ্ছে যে তুর্কি সামরিক বাহিনীর মূল নেতৃত্ব প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনুগতই রয়েছে, তবু ভেতরের বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে অভিজ্ঞ ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় গত রোববার লিখেছেন: কেউ যদি মনে করে সামরিক অভ্যুত্থান দমন করা একটা মুহূর্তের ব্যাপার, যার পর থেকে তুর্কি সেনাবাহিনী সুলতানের বাধ্য-অনুগতই থেকে যাবে, তাহলে বিরাট ভুল করা হবে। তিনি আরও লিখেছেন, এবারের অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বটে, কিন্তু তুরস্কের ইতিহাসের ইঙ্গিত হলো ভবিষ্যতের অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা সফল হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে তুরস্কের সেনাবাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেছেন, তাতে দেশটির স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তাঁর সব প্রতিপক্ষকে নিষ্ক্রিয় বা নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতা ও নিজের দলের রাজনৈতিক আধিপত্য যেভাবে নিরঙ্কুশ করতে চাইছেন, তা শুধু তুরস্কের গণতন্ত্রকেই দুর্বল করবে না, জাতি-রাষ্ট্র হিসেবেও তুরস্ক দুর্বল হয়ে পড়বে।
কোনো কোনো বিশ্লেষক শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তুরস্কের এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে ঘটানো হয়েছে এবং তাতে বাইরের শক্তির হাত আছে। অভ্যুত্থানের প্ররোচনা আমেরিকাপ্রবাসী ফেতুল্লাহ গুলেনই দিয়েছেন—এই অভিযোগ করার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সরকার গুলেনকে আশ্রয় দিয়েছে, সেখানে তাঁর দেখভাল করছে। এরদোয়ান গুলেনকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানানোর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে একটা বড় পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তুর্কি-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ক্ষতি হবে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন, তা আসলে ইতিমধ্যে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারই লক্ষণ। রুশ প্রেসিডেন্টকে এরদোয়ানের টেলিফোন করার বিষয়টিও এ ব্যাপারে ইঙ্গিতবহ। খবর বেরিয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন আগামী মাসে তুরস্ক সফরে যেতে পারেন।
সিরিয়াকে কেন্দ্র করে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক পক্ষে, রাশিয়ার অবস্থান তার বিপরীত পক্ষে। তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন চায়। সে জন্য তুরস্ক আইএস যোদ্ধাদের সব ধরনের সহযোগিতা জুগিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিমা মিত্ররা সহযোগিতা করছে আসাদবিরোধী অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে, যারা সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস নামে জোটবদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে আসলে আইএসের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করছিল না, তারা সহযোগিতা করছিল সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে। এ রকম অবস্থায় তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নতুন এক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটল। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ও নৈরাজ্যের মধ্যে তুরস্কের অবস্থা এখন কী হবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রুশ-মার্কিন হেজিমনির লড়াইয়ে তুরস্ক কী ভূমিকা নেবে—এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে আরও কিছু সময় লাগবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]