র্যাব গতকাল মঙ্গলবার রাতে সারা দেশে ২৬২ জন নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত কলেজসহ বেশ কিছুপ্রতিষ্ঠানের ১২ জন শিক্ষার্থীর নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে যাঁদের ছবি প্রচার করা হচ্ছে, এমন ১০ জনের নাম এতে অন্তর্ভুক্ত আছে।
তালিকার ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের গণমাধ্যম ও আইন শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে খোঁজখবর করা হচ্ছে।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের এই তালিকায় আছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর ছাত্র তৌহিদ রউফ ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেহজাদ রউফ; মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওসিফ হোসেন; নারায়ণগঞ্জের তোলারাম সরকারি কলেজের ইয়াসিন হোসেন (চঞ্চল); ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির রাহাত বিন আবদুল্লাহ; উত্তরার ইয়ারলি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র রোমিও; মানারাত কলেজের বিবিএর ছাত্র মো. সাব্বির হোসেন ওরফে শুভ; স্টেট কলেজের ছাত্র মো. ফিরোজ মিয়া; দারুল এহসান কওমি মাদ্রাসার ছাত্র মো. ইমরান; বগুড়ার শাহ সুলতান কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র এ কে এম সিয়াম এবং ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র আহমেদ আজওয়াজ ইমতিয়াজ তালুকদার। আরও আছেন সিভিল এভিয়েশনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট মো. মাহমুদুল হাসান রাতুল। এ ছাড়া আছেন জুন্নুন শিকদার, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবদুল্লাহ, তামিম আহমেদ চৌধুরী মো. সাইফুল্লাহ ওজাকি, মো. মহিবুর রহমান, তাহমিদ রহমান, তাউসিফ হোসেন, আরাফাত হোসেন তুষার, মো. নিয়াজ মোর্শেদ রাজা, নজিবুল্লাহ আনসারী, জুনায়েদ খান, জুবায়েদুর রহিম, এ টি এম তাজউদ্দিন ও আশরাফ মো. ইসলাম।
এই তালিকায় নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে আসা দুই তরুণের নাম আছে। তাঁদের একজন আফিফ মানসিফ চৌধুরী। তিনি ১ মার্চ নিখোঁজ হন এবং ফিরে আসেন ২২ মে। এ ছাড়া আছেন শামীম রেদওয়ান। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি নিখোঁজ হন। ফিরে আসেন মে মাসের শেষ সপ্তাহে। দুজনেই ঢাকা সেনানিবাসের বাসিন্দা।
চার সন্দেহভাজনের ভিডিও প্রকাশ: গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ চারজনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে র্যাব। তাঁদের ধরিয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
ভিডিও ফুটেজে এই চারজনকে ১ জুলাই রাতে গুলশান হামলার সময় রেস্তোরাঁর পাশের ৭৯ সামনের সড়ক থেকে জব্দ করা ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছিল বলে র্যাবের কর্মকর্তারা জানান।
গতকাল মঙ্গলবার র্যাব এই চারজনের ভিডিও ফুটেজ তাদের ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছে। ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে র্যাব জানায়, রেস্তোরাঁয় হামলার আগে তাঁদের একজন সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার থেকে নেমেছিলেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে এই চারজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাঁরা জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন। ভিডিও দেখে কেউ তাঁদের শনাক্ত করতে পারলে তাঁদের ধরিয়ে দিতে তিনি অনুরোধ করেন। ভিডিও ফুটেজে এই চারজনকে ৭৯ নম্বর সড়কে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে। একে অন্যের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে দেখা গেছে। এক নারীকে সন্দেহভাজনদের একজনের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়।
গতকাল বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের একই ধরনের ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের (সিটি) ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১ জুলাই রাতে সন্দেহভাজন তিন যুবক ৮টা ৪২ মিনিটে গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এর আগে তাঁদের একজন সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার থেকে নেমে পড়েন। সন্দেহভাজন নারীকে গাড়ি থেকে নামা যুবকটির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ১ জুলাই রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে হলি আর্টিজান থেকে প্রথম গ্রেনেড ছোড়ার সময় সন্দেহভাজন তিন যুবক ৭৯ নম্বর সড়কেই ছিলেন। এরপর তাঁরা চলে গেলেও সন্দেহভাজন নারী প্রায় সেখানে আধঘণ্টা অবস্থান করেন। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে তাঁরা হামলাকারীদের সহযোগী। তাঁদের ও সাদা গাড়িটির মালিককে পাওয়া গেলে মামলা-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ: হলি আর্টিজানে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের বাসা ভাড়া দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এম গিয়াস উদ্দিন আহসান তাঁর ফ্ল্যাটের তত্ত্বাবধায়ক মাহবুবুর রহমান ও ভাগনে আলম চৌধুরী এবং শেওড়াপাড়া থেকে গ্রেপ্তার সাবেক শিক্ষক নুরুল ইসলামের রিমান্ডের গতকাল দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। গত শনিবার তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে হলি আর্টিজানে হামলায় নিহত শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বলকে সহযোগিতার অভিযোগে মিলন হোসাইনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা জেলার পুলিশ। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমান্ডে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গিয়াসসহ পাঁচজন হামলাকারীকে সহায়তা করার কথা অস্বীকার করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে গিয়াসউদ্দিন বলেন, ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে সব দেখাশোনা করছিলেন তাঁর ভাগনে ও ফ্ল্যাটের তত্ত্বাবধায়ক। এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, মিরপুরের আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম অন্য ভাড়াটেদের তথ্য সংগ্রহ করলেও চার জঙ্গির কোনো তথ্য নেই তাঁর কাছে।
পুলিশ লাশ হস্তান্তর করতে চায়: হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জনের লাশ ১৯ দিনেও তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত লাশগুলো সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে ছিল।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর বাবুর্চি সন্দেহভাজন সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলে আসছেন, তাঁরা লাশ নিতে এর আগে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের কিছুই বলছে না।
অবশ্য মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিসহ নিহত ছয়জনের পরিবারের কেউ লাশ নিতে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাঁরা লাশ নিতে চাইলে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে লাশ হস্তান্তর করা হবে। তিনি বলেন, নিহত ছয়জনের লাশ আরও কিছুদিন মর্গে রাখা হবে। এ সময়ের মধ্যে স্বজনেরা লাশ না নিলে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হবে।