জামায়াতকে ছাড়াই জঙ্গিবাদবিরোধী ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ার চাপ বাড়ছে বিএনপিতে। দলের বেশিরভাগ সিনিয়র নেতা দেশ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে জামায়াতের সঙ্গে আপাতত দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিচ্ছেন। বিএনপির একক নেতৃত্বেই ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ার পক্ষে তারা। বিএনপির ব্যানারেই ঢাকায় ‘জাতীয় কনভেনশন’ করার পক্ষে তাদের অবস্থান। দলের নেতাদের পাশাপাশি দল সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশও বিএনপির একক উদ্যোগেই জাতীয় কনভেনশন করার পরামর্শ দিচ্ছে। গতকাল রাতেও মতবিনিময়কালে খালেদা জিয়াকে দু’জন বুদ্ধিজীবী জামায়াতকে ছাড়াই জাতীয় ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে জামায়াতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের ‘রূপরেখা’ তৈরি করবে বিএনপি। এরই মধ্যে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা হোমওয়ার্ক শুরু করেছেন।
রূপরেখায় কী কী বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নেওয়া হবে। জামায়াতকে দূরে রাখার পরও আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ার ব্যাপারে এগিয়ে এলে রূপরেখা একরকম হবে, আর না এলে ভিন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ নির্মূলের পাশাপাশি দেশে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ বিষয়টিও প্রাধান্য দেবে বিএনপি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এখন সকলের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার আহ্বানে সাড়া দেবে। কিন্তু সরকারি দলের নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য ও কনভেনশন বিএনপির ব্যানারে হবে, না ২০ দলীয় ব্যানারে হবে_ তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে আলোচনা চলছে।
সূত্র জানায়, গতকাল রাতে গুলশান কার্যালয়ে জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে মতবিনিময়কালে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেছেন, জাতীয় ঐক্য জামায়াত ছাড়া করা উচিত। জামায়াতকে রাখলে ওই ঐক্যে ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীরা আসবেন না। এক্ষেত্রে আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো পৃথক মঞ্চ থেকে আন্দোলন করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, নির্বাচনী জোট পর্দার আড়ালে থাকতে পারে। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
সূত্র জানায়, জঙ্গিবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকেও চিঠি দেবে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বুধবার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের সিনিয়র নেতাদের ২০ দলীয় জোটের বাইরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপি নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে জোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে সমর্থন নিয়েছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক করে নেতাদের ২০ দলীয় জোটের বাইরে গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, জামায়াত এখন বিএনপির জন্য বোঝা। জামায়াতকে ত্যাগ ছাড়া বিএনপি সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। দেশি-বিদেশি সব মহল থেকেই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপির ওপর চাপ রয়েছে। বর্তমান জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও অনেকে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির ভোটের রাজনীতির হিসাব বাদ দিয়ে আপাতত অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতি করা উচিত।
সূত্র জানায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না করে কৌশলী ভূমিকাও নিতে পারে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বের করে না দিয়েও দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নিতে পারে দলটি। ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় কনভেনশন না করার চিন্তাভাবনাও চলছে।
সূত্র জানায়, জঙ্গি ইস্যুতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের করণীয় কী, তা ঠিক করার জন্যই জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে জাতীয় কনভেনশন করার প্রস্তাব ওঠে। কনভেনশনের ব্যাপারে জামায়াত সমর্থন জানালে বিএনপির এক নেতা বলেন, জামায়াতের কারণে সরকার জাতীয় ঐক্য করতে আগ্রহী নয়। এ ব্যাপারে জামায়াতের প্রতিনিধি বলেন, জামায়াতকে জোটে রাখা না রাখা কিংবা থাকা না থাকার বিষয়টি সিদ্ধান্ত নেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও জামায়াতের শীর্ষ নেতা।
গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের প্রতি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানের পর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় তাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়।
বৈঠকে জাতীয় ঐক্যের চেয়ে জাতীয় কনভেনশনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন জোটের শীর্ষ এক নেতা। তিনি বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে সরকার আগ্রহী নয়। তাই অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত। অপর এক জোটের নেতা বলেন, গণফোরাম নেতা বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ বাম মোর্চার অনেকেই আসবেন না। জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে কনভেনশন করা হলে অনেকেই কনভেনশনে আসবেন।
জোটের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে সরকার মনে করলে ২০ দলীয় জোট থেকে বাদ দিতে হবে কেন_ সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি এক ঘোষণায় বন্ধ করা যায়।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকের পর খালেদা জিয়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যানদের নিয়ে বৈঠক করেন।