রাজধানীর গুলশানে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ‘নিখোঁজ’ তরুণরাই এসব হামলায় জড়িত ছিল। এর পর পরিবার থেকে রহস্যজনক কারণে নিখোঁজদের ব্যাপারে টনক নড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে নিখোঁজ তরুণদের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নিখোঁজদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দিতে দেশের সব থানার ওসিদের নির্দেশ দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গুলশানে হলি আর্টিসানে রক্তাক্ত হামলার পর যে ১০ তরুণের নিখোঁজ হওয়ার তালিকা প্রকাশ পায়, তাতেও বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। ওই তরুণদের মধ্যে দু’জন বিদেশি পাসপোর্টধারী। একজন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের এ দেশের প্রধান নেতা অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম মাওলার স্ত্রী পরিচালিত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক। অপরজন একই স্কুলের ছাত্র ছিল বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রত্যেক থানায় নিখোঁজদের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হবে। যাচাই-বাছাই করে ওসিদের ওই তালিকা এক সপ্তাহের মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, অনেক সময় নিখোঁজ হলে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এসব ডায়েরির সূত্র ধরে তদন্তে পাওয়া প্রতিবেদন ছাড়াও থানা পুলিশ স্থানীয়ভাবে নিখোঁজদের তালিকা করবে। এ জন্য প্রয়োজনে থানা থেকে ইউনিয়ন, গ্রাম থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, শিক্ষক বা স্থানীয় তরুণদের কেউ সন্দেহজনকভাবে নিখোঁজ থাকলে তালিকায় তাদের নাম উঠবে। অনেক সময় ব্যক্তিগত নানা কারণে অনেকে নিখোঁজ হন, মামলার কারণে আত্মগোপনে থাকেন, এসব বিষয় যাচাই করা হবে। এর পর তালিকা চূড়ান্ত করে নিখোঁজদের অবস্থান শনাক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে রক্তাক্ত হামলার পর জানা যায়, মূল হামলাকারী নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মুবাশীর, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ওরফে খায়রুজ্জামান ও শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ নিখোঁজ ছিল। তাদের অনেকের পরিবার থানায় জিডি করলেও কয়েকজনের পরিবার এ নিয়ে পুলিশকে কিছুই জানায়নি। এ রক্তাক্ত ঘটনার ছয় দিনের মাথায় শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে পুলিশ চেকপোস্টে হামলায় জড়িত আবীর রহমান ও শফিউল ইসলামও দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল।
দেশে ভয়াবহ এ দুটি জঙ্গি হামলার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, রহস্যজনক কারণে নিখোঁজ এসব শিক্ষিত তরুণ মূলত জঙ্গিদের আস্তানায় ঢুকেছিল। গোপন শিবিরে এরা নিবিড়ভাবে অস্ত্র চালনা ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ নিয়ে নৃশংস হামলায় অংশ নিয়েছে। এ গ্রুপটির সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা, সম্প্রতি পৃথক দুটি হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া সাত জঙ্গির মতো অন্তত দেড়শ’ তরুণ তাদের পরিবারের কাছ থেকে নিখোঁজ রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের কেউ কেউ হয়তো বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের হয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। অনেকে ফিরে এসে দেশে নাশকতার পরিকল্পনাও করছে। এ কারণে রহস্যজনক কারণে এসব নিখোঁজ তরুণের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে।
দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গুলশান হামলার পর প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত যে নিখোঁজ ১০ জনকে স্বজনরা ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের নিয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্যও তারা পেয়েছেন। ১০ জনের মধ্যে ঢাকার পান্থপথ এলাকার আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম (২২) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। তার (ব্রিটিশ) পাসপোর্ট নম্বর-৫২৫৮৪১৬২৫। তালিকার অপরজন সিলেট বিয়ানীবাজারের তামিম আহম্মেদ চৌধুরী কানাডার পাসপোর্টধারী। সেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক।
সূত্র আরও জানায়, নিখোঁজ ওই ১০ জনের মধ্যে ধানমণ্ডির জুবায়েদুর রহিম লেকহেড গ্রামার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ওই স্কুলটি হিযবুত তাহ্রীরের প্রধান নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কৃত শিক্ষক কারাবন্দি সৈয়দ গোলাম মাওলার স্ত্রী জেনিফার আহমেদ পরিচালনা করতেন। ধানমণ্ডি ছাড়াও গুলশান-১, মোহাম্মদপুর ও বনানীতে স্কুলটির শাখা রয়েছে। আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম ওই স্কুলের ছাত্র ছিল। একই স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিও তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা। আগে থেকেই এ দু’জনের বিরুদ্ধে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।