গুলশানের অভিজাত রেস্টুরেন্ট হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি হামলার পর প্রথম সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই আহ্বান জানিয়েছেন দলটির মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা। সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্যে খালেদা জিয়ার আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করা হলেও জাতীয় ঐক্যের অবস্থান থেকে সরেনি বিএনপি। খালেদা জিয়াসহ দলটির সিনিয়র নেতারা গতকাল পর্যন্ত দফায় দফায় সে আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করেছেন। গুলশান ট্রাজেডির পরদিন গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে প্রথম জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আমি আবারও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, এই নিষ্ঠুর বিবেকবর্জিত গণতন্ত্র ও সভ্যতাবিরোধী উগ্রবাদী শক্তিকে নির্মূল করতে দলমত নির্বিশেষে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাই।
সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এখনই এই উগ্রবাদী শক্তিকে দমন করতে না পারলে এরা দীর্ঘতম যুদ্ধ চালিয়ে দেশের জনগণের শান্তি, সুস্থিতি, নিরাপত্তা বজায় রাখা কঠিন করে তুলবে। ঘটনার একদিন পর ৩রা জুলাই দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা ডাকেন খালেদা জিয়া। সভাশেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন নিজেই বক্তব্য দেন। সেদিন আরো পরিষ্কারভাবে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, কে ক্ষমতায় থাকবে আর কে ক্ষমতায় যাবে- সেটা আজ বড় কথা নয়। দেশ ও জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। আমাদের কোনো অর্জনই টিকবে না যদি আমরা সন্ত্রাস দমন করতে না পারি। সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে এই সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। তাই সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি। খালেদা জিয়া আরো বলেন, এ সন্ত্রাসী ঘটনা এটা আমাদের জন্য নতুন এক ভয়াবহ জাতীয় সংকট। শুক্রবার রাতের ঘটনায় শুধু একটি রেস্তরাঁ নয়, সারা বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা, আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাপন পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই সকলের মিলিত প্রয়াসে আমাদের এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান দিয়ে এই সন্ত্রাস মোকাবিলা করা যাবে না। এই সংকটের শেকড় আরো অনেক গভীরে। সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের জাতীয় সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কেবল গণতান্ত্রিক পরিবেশেই জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে। এই আতঙ্ক, এই হত্যালীলা থামাতে হবে। বন্ধ করতে হবে রক্তপাত। আমাদের একতাবদ্ধ হতেই হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। পরে ৭ই জুলাই ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানেও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান পুনরাবৃত্তি করে খালেদা জিয়া বলেন, এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সকলে মিলে দেশে যে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটছে, তা বন্ধ করা দরকার। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, যারা জোর করে ক্ষমতায় আছে, তারা জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত নয়। তারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা ও সান্ত্বনা দেয়ার বদলে যা ইচ্ছে কথাবার্তা বলছে।
এদিকে ঘটনার দিন দেয়া এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমি সরকারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রতীক এই উগ্রবাদী জঙ্গিদের সন্ত্রাসের সংগঠন ও পরিকাঠামো নিশ্চিহ্ন করতে হলে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি। আর এই জরুরি কাজটি সরকারকেই করতে হবে। সরকার এখন যদি এই মানবতাবিরোধী উগ্রবাদীদের নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের খেলায় মেতে থাকেন, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। পরে ৫ই জুলাই দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য গঠনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিতে সরকারের প্রতি ফের আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এখন সবচেয়ে যে জিনিসটি বেশি প্রয়োজন তা হলো ভয়াবহ সন্ত্রাস ও উগ্রবাদকে প্রতিরোধ করার জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে জাতীয় ঐক্যের যে ডাক দিয়েছেন- আমাদের বিশ্বাস তার এ আহ্বান পুরো দেশের মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। শুধু দেশের মানুষই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার এ বক্তব্য অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
বিএনপি আশা করে, সরকার এবং সরকারি দল তাদের দাম্ভিকতা বাদ দিয়ে এবং দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে ও বৃহত্তর কল্যাণে খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্র তৈরির উদ্যোগ নেবে। এদিকে দলীয় প্রধানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। শনিবার চট্টগ্রামের নিজ বাসভবনে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তিনি বলেন, জঙ্গি হামলা ও সন্ত্রাসী তৎপরতা জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। এই সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার যদি এই সংকট নিরসন করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অবিলম্বে জাতীয় সংলাপ আহ্বানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের রুদ্ধ কপাট খুলে দেয়া। একইভাবে গতকাল নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একমাত্র জাতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব। রাজনীতিতে বিচ্ছেদ, বিনাশ, ব্যবধানের চর্চা অব্যাহত থাকলে কোনো না কোনোরূপে ভিন্নমত বিধ্বংসী উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দেবেই। প্রকৃত গণতন্ত্রে ভিন্নমতের সহাবস্থান জোরালো হয় বলেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি তৈরি হয়।