গুলশানে নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলার পর এবার রক্তাক্ত হলো শোলাকিয়ার ঈদগাহ্ ময়দান। একের পর এক জঙ্গি হামলার মধ্যে এই দুই ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা দেশ। শোকাহত মানুষ। সন্ত্রাসী জঙ্গি হানা ঈদের আনন্দে যোগ করেছে আতঙ্ক আর উদ্বেগ। গুলশানের হামলার পর আইএস দায় স্বীকার করলেও শোলাকিয়ার ঘটনায় এখনও দায় স্বীকার করেনি কেউ। তবে পুলিশ বলছে গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনায় জেএমবি জড়িত। ঘটনা দুটি তদন্তে তিন দেশের সহায়তা নেয়ার কথাও জানানো হয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যে ফের হামলার হুমকি দিয়েছে আইএস। বাংলায় কথা বলা তিন তরুণের কথিত ভিডিও প্রকাশ করার তথ্য জানিয়েছে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ। পরিস্থিতির আলোকে সন্ত্রাস দমনে ঢাকার পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। উদ্ধৃত পরিস্থিতিতে আজ ঢাকা আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল।
একের পর এক জঙ্গি হামলা চলছেই। জঙ্গি হামলা ঠেকানোর কর্ম-কৌশল নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিভাবে জঙ্গিদের প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে চলছে বৈঠক-আলোচনা। গুলশানের হামলার ঘটনার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আরো হামলা হতে পারে এই আশঙ্কায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যেই ঈদের দিন দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশ গেটে পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। দ্রুততম সময়ে পরপর দুটি হামলার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তাই বর্তমানে জঙ্গিদের প্রতিরোধের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিটকে। এমনকি জঙ্গিরা যেসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ করছে তাতেও বিস্মিত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যোগাযোগের এসব টুলসও গোয়েন্দা নজরদারিতে আনার চেষ্টা চলছে। প্রযুক্তি ও ফরেনসিক সহায়তার জন্য পুলিশ ভারতসহ তিন দেশের সহায়তা নিচ্ছে। এরই মধ্যে ভারতীয় ফরেনসিক ও বোমা বিশেষজ্ঞদের একটি দল ঢাকায় পৌঁছেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি’র একটি অংশ জড়িত। এই অংশটি ভয়াবহ হিংস্র। তারা নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই গ্রুপটিতে শিক্ষিত অনেক তরুণ সম্পৃক্ত হয়েছে। এই গ্রুপের নেতাদের ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে গোয়েন্দারা। পুলিশের আইজিপি একেএম শহীদুল হকও বলেছেন, ‘গুলশানে যারা হামলা করেছে, তারাই শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছে, তারা জেএমবি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য।’ তিনি বলেন, ‘শোলাকিয়ায় হামলায় যারা আটক হয়েছে, তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে যে গুলশানে হামলাকারীদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।’
সূত্র জানায়, ধারাবাহিক জঙ্গি হামলা ঠেকাতে সাঁড়াশি অভিযানের পরিবর্তে গোপনীয় তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের সব ইউনিটে জঙ্গি প্রতিরোধ সেল তৈরি করার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এসব সেল জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম মনিটর করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করবে। পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার তত্ত্বাবধানে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো সমন্বয় করে অভিযান চালানো হবে। একই সঙ্গে পুলিশের নবগঠিত কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে আরো বেশি শক্তিশালী ও প্রযুক্তিবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে। পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি ও এলিট ফোর্স র্যাবকে জঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআইয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে জঙ্গি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিদের জিম্মি আক্রমণ প্রতিরোধ করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এছাড়া, বিশেষায়িত ইউনিট ছাড়া সারা দেশে থানা-পুলিশের জঙ্গি প্রতিরোধ সম্পর্কিত কোনো ধারণাও নেই। এ কারণে জঙ্গিদের তৎপরতার তথ্য মাঠ পর্যায় থেকে আসে কম। ক্রমবর্ধমান জঙ্গি হামলার কারণে পুলিশের সকল ইউনিটকে জঙ্গি প্রতিরোধ সম্পর্কিত কর্ম-কৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা হচ্ছে। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘আমাদের পুলিশ আগে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ধরার জন্য কাজ করতো। ওয়ে অফ অ্যাকশন, ট্রেনিং, পারসেপশন এক ধরনের ছিল। এখন ট্রেনিংয়ের প্যাটার্ন, পারসেপশনে চেঞ্জ আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ওয়ে অফ অ্যাকশন, মুড অফ অ্যাকশন পরিবর্তন করে ফেলবো। এখন যেই ধরনের অপরাধ হচ্ছে তা দমনে ভেতরে ভেতরে আমরা কাজ করছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে এখন দুই আদর্শের জঙ্গি গ্রুপ তৎপর রয়েছে। এর একটি ইসলামিক স্টেট বা আইএসপন্থি হিসেবে পরিচিত। আর আরেকটি গ্রুপ হলো আল কায়েদাপন্থি। জেএমবি’র ভগ্নাংশ দলটি আইএসকে তাদের আদর্শ মনে করে। তারা অনেক আগে থেকেই আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। গুলশানের ঘটনার পর বোঝা গেছে যে, তারা ইতিমধ্যে আইএসের সঙ্গে শক্ত যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছে। সূত্র জানায়, দুটি জঙ্গি গ্রুপই স্লিপার সেল পদ্ধতিতে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। একারণে জঙ্গি গ্রুপটির টপ লিডার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের যে দুটি গ্রুপ বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে তারা খুবই দক্ষ। তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে যেমন ভালো জানে তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশল সম্পর্কেও অবগত। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম। একারণে তাদের ধরতে পুলিশের বিকল্প পথ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আন্ডার কাভার বা স্টিং অপারেশন চালাতে হবে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গি প্রতিরোধে আমাদের কাজ করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। তারা যেমন ‘কুল’ হয়ে কাজ করে, আমাদের তার চেয়েও বেশি ‘কুল’ হয়ে কাজ করতে হবে। ধূমধাম অভিযান চালিয়ে সফলতা হবে না। তারা যে আদর্শ লালন করে, যাদের অনুসরণ করে তার ভেতরে ঢুকতে হবে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সেভাবেই কাজ শুরু করেছে।
গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় জেএমবি: পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর গুলশানে ও শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠে যারা হামলা চালিয়েছে তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবির একটি ভগ্নাংশ। এই গ্রুপটি জেএমবি’র সর্বশেষ আমীর কারাবন্দি মাওলানা সাইদুরকে অস্বীকার করে নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ডাক্তার নজরুল নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে জেএমবি’র এই ভগ্নাংশটি সংগঠিত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে এসব তথ্য মিলেছে। এই গ্রুপটি ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হওয়ার পর থেকেই তারা একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মাওলানা সাইদুরের অনুসারী জেএমবি গ্রুপটি বর্তমানে পুলিশি তৎপরতার কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। কিন্তু ডাক্তার নজরুলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গ্রুপটি প্রথমে উত্তরাঞ্চলে সংগঠিত হয়। এরপর তারা ঢাকার উচ্চবিত্ত শিক্ষিত তরুণদের টার্গেট করে মাঠে নামে। উচ্চবিত্ত তরুণদের অনেকেই আগে হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু হিযবুতের ধীরে চলো নীতি তারা মানতে না পেরে অধিক উগ্রপন্থি দলের সঙ্গে যোগ দেয়। বিশেষ করে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তারা অনুপ্রাণিত হয়। এসব তরুণের অনেকেই সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও অংশ নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইএস নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ দেশে অবস্থান করে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করার নির্দেশনা দেয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তারা দেশে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে।
জঙ্গিরা ব্যবহার করছে উন্নত প্রযুক্তি: গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিরা বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তারা নিত্য-নতুন অ্যাপস ব্যবহার করে। গুলশানের হোলি আর্টিজান রেঁস্তরায় হামলার পরও জঙ্গিরা বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে ছবিগুলো তাদের নিজেদের লোকজনের কাছে পাঠায় বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, জঙ্গিরা সাধারণত মোবাইল ফোন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কমন উপকরণগুলো ব্যবহার করছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগ নজরদারি করে থাকে। কিন্তু জঙ্গিরা ‘প্রটেক্টেড টেক্সট’ ঘরানার এমন কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করে যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারি করতে পারে না। এসব সফটওয়্যার ব্যবহারের সময় সার্ভার পার হওয়ার সময় বার্তাগুলো এনক্রিপ্ট হয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গিদের যোগাযোগের উপকরণ নিয়ে গবেষণা করছে। এসব কিভাবে নজরদারির আওতায় আনা যায় তার কর্ম-কৌশল নির্ধারণ চলছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রয়োজনে এসব উপকরণ নজরদারি করতে বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন করা হবে।
তিন দেশের সহায়তা নিচ্ছে পুলিশ: পুলিশ বলছে, গুলশান ও শোলাকিয়ার সাম্প্রতিক হামলাসহ সাম্প্রতিক জঙ্গি প্রতিরোধে প্রতিবেশী দেশসহ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হবে। বিশেষ করে গুলশানের হামলার ঘটনায় ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য এই সহায়তা নেয়া হবে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গুলশানের হামলার পর অনেক দেশই সহায়তা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ভারত, সিঙ্গাপুর ও আমেরিকার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, গুলশানের ঘটনাসহ সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশের চৌকস, প্রতিভাবান পুলিশ কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তাদের বিদেশি প্রশিক্ষণ রয়েছে। তারা হাইলি কোয়ালিফাইড। কিন্তু কিছু রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য, যেমন ল্যাব পরীক্ষা, এই ধরনের টেকনোলজির আমাদের অভাব রয়েছে। সেই ধরনের পরীক্ষার জন্য কেমিক্যাল এক্সামিনের রিপোর্ট যেখানে ভালো হয় অর্থাৎ সিঙ্গাপুর, ভারত বা ইউএসএ, সেখানে আমরা এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছি। অর্থাৎ কারিগরি সহায়তার জন্য বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তা গ্রহণ করতে পারি।’ এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল ঢাকায় পৌঁছেছে। তবে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা তথ্য দিতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জঙ্গিরা যেসব অ্যাপস ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগ করছে সেসব বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখবে বিদেশি গোয়েন্দারা।
সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রস্তাব ভারতের
পরিতোষ পাল, কলকাতা থেকে জানান, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বাংলাদেশকে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীকে লেখা এক চিঠিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সন্ত্রাস মোকাবিলায় সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে গুলশানে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ভারতের এলিট ন্যাশনাল সিকিউরিটি হার্ড এনএসজির কমান্ডোরা ঢাকা গিয়েছেন বলে মিডিয়াতে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাকে ভুল ও মিথ্যা বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ। তিনি জানিয়েছেন, কমান্ডোরা বাংলাদেশে গিয়েছেন বলে যা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। গত শুক্রবার সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ঘৃণা, হিংসা ও সন্ত্রাসের তাত্ত্বিক হুমকি থেকে দুই দেশের সমাজকে রক্ষা করতে এবং সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে লড়াই করবে। তিনি আরো লিখেছেন, সর্বস্তরে সন্ত্রাস মোকাবিলায় আমাদের সার্বিকভাবে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলা প্রয়োজন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, পবিত্র রমজান মাসে সন্ত্রাসীরা হত্যালীলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই, বিশ্বাস বলে কিছু নেই। সুষমা স্বরাজ আশা প্রকাশ করে লিখেছেন, এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সফর হবে এবং আবার বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এদিকে ভারতীয় ইসলামী ধর্ম প্রচারক ডা. জাকির নায়েকের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের গুলশান হামলার দুজন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে জানানোর পর বাংলাদেশ সরকার এ সম্পর্কে ভারতের কাছে তথ্য চাওয়ার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নড়েচড়ে বসেছে। ইতিমধ্যেই নায়েকের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখার বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তদন্ত শুরু করেছে। জাকির পরিচালিত পিস টিভির সম্প্রচার ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক-দেড় বছর আগে থেকেই জাকিরের উস্কানিমূলক বক্তব্য নিয়ে সরকারকে সতর্ক করলেও এতদিন সরকার এ ব্যাপারে তৎপরতা দেখায়নি। তবে নায়েকের ব্যাপারে বাংলাদেশের বিস্তারিত জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার নায়েকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ভারতের অধিকাংশ ইমাম ও মৌলভীরাও জাকিরের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। ইসলামের নামে তিনি যে সন্ত্রাসের প্ররোচনা দিচ্ছেন তাকে ইসলাম বিরোধী বলে জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছেন ইমামরা।
ঢাকা হামলার পর আবেকে ওবামার চিঠি
গুলশান ক্যাফেতে নিহত জাপানিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের কাছে চিঠি লিখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পরশু পাঠানো ওই চিঠিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাপান, বাংলাদেশ ও বিশ্বের বাকি দেশগুলোর সঙ্গে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়। চিঠিতে ওবামা জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন, মার্কিন জনগণের পক্ষে আমি- ঢাকায় ১-২রা জুলাইয়ের ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলায় নির্মমভাবে নিহত ৭ জাপানি নাগরিকের পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আশা করছি, হামলায় আহত জাপানি নাগরিক দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। এই হামলা আরো বেশি নিষ্ঠুর ছিল এই কারণে যে, আপনার দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ছিল ঢাকায়। ওবামা আরো বলেন, আমি কঠোরতম ভাষায় এতগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া নৃশংস ওই হামলার নিন্দা জানাই।
বাংলায় আইএসের ভিডিও, আরো হামলার হুমকি
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এতে, কথা বলতে দেখা যায় আইএসে যোগ দেয়া বাংলাদেশি ৩ যুবককে। তারা হলি আর্টিজানে হামলার প্রশংসা করে আরো হামলার হুমকি দেয়া হয়। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর অনলাইন তৎপরতা নজরদারি করা মার্কিন সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ মঙ্গলবার ভিডিওটি প্রথম প্রকাশ করে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে আইএসের ভিডিওতে কথা বলা ২ বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছেন। এদের একজন ছিলেন গায়ক (তাহমিদ রহমান শাফি), একজন ডেন্টিস্ট (তুষার)। ভিডিওতে দেখা যায়, কোনো একটি বিদেশি শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
প্রায় ৬ মিনিট দীর্ঘ ওই ভিডিওর শুরুতেই দেখানো হয়, ঢাকাসহ বিশ্বব্যাপী আইএসের দাবি করা হামলার নিয়ে প্রচারিত টিভি সংবাদের ক্লিপ। ব্যাকগ্রাউন্ডে চলছিল আরবী ভাষার একটি গান যা আইএসের বিভিন্ন ভিডিওতে আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। এরপরই এক যুবক বাংলায় বক্তব্য দেয়া শুরু করে। তার পরনে ছিল শার্ট। কাঁধে ব্যাগ। বাংলাদেশ সরকার ও কর্মচারীদের হুমকি দিয়ে সে বলছিল, এবার তারা যে ‘জিহাদ’ প্রত্যক্ষ করেছে সেটা আগে কখনও দেখেনি। ভবিষ্যতে আরো হামলা হবে বলে হুমকি দেয় সে। শেষ অংশে সে ইংরেজিতে বার্তা দেয় ‘ক্রসেডার’দের উদ্দেশ্যে। বক্তব্যে ক্যাফে হামলার ঘটনাকে ‘গতকালের’ হামলা বলে উল্লেখ করে ওই যুবক। ফলে ধারণা করা হচ্ছে ভিডিওটি হামলার পরদিন ধারণ করা। তার বক্তব্যের পর আরো দুজন যুবক বক্তব্য দেয় বাংলায়। ২য় ব্যক্তি ছিল পাঞ্জাবি পরা। তার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। ভিডিও’র শেষের বক্তা ছিল টি-শার্ট পড়া। মুখে দাড়ি। মাথায় কালো টুপি এবং কাঁধে ব্যাগ। সে গুলশান হামলাকারীদের প্রশংসা করছিল।
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর ইতিমধ্যে অনেকে তাদের চিনতে পেরেছেন। তাদের পরিচয়ও সামনে এসেছে। তিনজনের মধ্যে অন্তত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভিডিওর প্রথম বক্তার নাম তাহমিদ রহমান শাফি। সে একজন সঙ্গিতশিল্পী ছিল। ক্লোজআপ ওয়ানের প্রথম আসরে সে শীর্ষ ১৫ জনের মধ্যে ছিল। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে এক সময় গ্রামীণ ফোনে কাজ করতো সে। তাহমিদ সাবেক নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমানের ছেলে বলে জানিয়েছেন তার সহপাঠীরা। বছর খানেক আগে সে সস্ত্রীক তুরস্ক চলে যায়। দ্বিতীয় যুবকের নাম তুষার। সে প্রয়াত মেজর ওয়াশিকুর আজাদের ছেলে। সে পেশায় ডেন্টিস্ট ছিল। আনুমানিক বছর দুই ধরে নিখোঁজ।
নিসা দেশাই ঢাকা আসছেন আজ
গুলশানে রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার পর আনুষ্ঠানিক দুদিনের সফরে আজ ঢাকা আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়াল। সফরকালে নিশা দেশাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ছাড়াও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, রেস্তোরাঁয় হামলা তদন্তে সহায়তায় মার্কিন প্রস্তাব এবং মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। এছাড়া সফরে সামপ্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনাসহ কিছুদিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় মার্কিন মিশনের সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানসহ দু’জনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। প্রসঙ্গত, জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের পর ৫ই মে নিশা বিসওয়াল জরুরি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।
একের পর এক জঙ্গি হামলা চলছেই। জঙ্গি হামলা ঠেকানোর কর্ম-কৌশল নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিভাবে জঙ্গিদের প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে চলছে বৈঠক-আলোচনা। গুলশানের হামলার ঘটনার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আরো হামলা হতে পারে এই আশঙ্কায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যেই ঈদের দিন দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশ গেটে পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। দ্রুততম সময়ে পরপর দুটি হামলার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তাই বর্তমানে জঙ্গিদের প্রতিরোধের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিটকে। এমনকি জঙ্গিরা যেসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ করছে তাতেও বিস্মিত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যোগাযোগের এসব টুলসও গোয়েন্দা নজরদারিতে আনার চেষ্টা চলছে। প্রযুক্তি ও ফরেনসিক সহায়তার জন্য পুলিশ ভারতসহ তিন দেশের সহায়তা নিচ্ছে। এরই মধ্যে ভারতীয় ফরেনসিক ও বোমা বিশেষজ্ঞদের একটি দল ঢাকায় পৌঁছেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি’র একটি অংশ জড়িত। এই অংশটি ভয়াবহ হিংস্র। তারা নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই গ্রুপটিতে শিক্ষিত অনেক তরুণ সম্পৃক্ত হয়েছে। এই গ্রুপের নেতাদের ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে গোয়েন্দারা। পুলিশের আইজিপি একেএম শহীদুল হকও বলেছেন, ‘গুলশানে যারা হামলা করেছে, তারাই শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছে, তারা জেএমবি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য।’ তিনি বলেন, ‘শোলাকিয়ায় হামলায় যারা আটক হয়েছে, তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে যে গুলশানে হামলাকারীদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।’
সূত্র জানায়, ধারাবাহিক জঙ্গি হামলা ঠেকাতে সাঁড়াশি অভিযানের পরিবর্তে গোপনীয় তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের সব ইউনিটে জঙ্গি প্রতিরোধ সেল তৈরি করার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এসব সেল জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম মনিটর করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করবে। পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার তত্ত্বাবধানে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো সমন্বয় করে অভিযান চালানো হবে। একই সঙ্গে পুলিশের নবগঠিত কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে আরো বেশি শক্তিশালী ও প্রযুক্তিবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে। পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি ও এলিট ফোর্স র্যাবকে জঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআইয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে জঙ্গি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিদের জিম্মি আক্রমণ প্রতিরোধ করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এছাড়া, বিশেষায়িত ইউনিট ছাড়া সারা দেশে থানা-পুলিশের জঙ্গি প্রতিরোধ সম্পর্কিত কোনো ধারণাও নেই। এ কারণে জঙ্গিদের তৎপরতার তথ্য মাঠ পর্যায় থেকে আসে কম। ক্রমবর্ধমান জঙ্গি হামলার কারণে পুলিশের সকল ইউনিটকে জঙ্গি প্রতিরোধ সম্পর্কিত কর্ম-কৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা হচ্ছে। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘আমাদের পুলিশ আগে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ধরার জন্য কাজ করতো। ওয়ে অফ অ্যাকশন, ট্রেনিং, পারসেপশন এক ধরনের ছিল। এখন ট্রেনিংয়ের প্যাটার্ন, পারসেপশনে চেঞ্জ আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ওয়ে অফ অ্যাকশন, মুড অফ অ্যাকশন পরিবর্তন করে ফেলবো। এখন যেই ধরনের অপরাধ হচ্ছে তা দমনে ভেতরে ভেতরে আমরা কাজ করছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে এখন দুই আদর্শের জঙ্গি গ্রুপ তৎপর রয়েছে। এর একটি ইসলামিক স্টেট বা আইএসপন্থি হিসেবে পরিচিত। আর আরেকটি গ্রুপ হলো আল কায়েদাপন্থি। জেএমবি’র ভগ্নাংশ দলটি আইএসকে তাদের আদর্শ মনে করে। তারা অনেক আগে থেকেই আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। গুলশানের ঘটনার পর বোঝা গেছে যে, তারা ইতিমধ্যে আইএসের সঙ্গে শক্ত যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছে। সূত্র জানায়, দুটি জঙ্গি গ্রুপই স্লিপার সেল পদ্ধতিতে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। একারণে জঙ্গি গ্রুপটির টপ লিডার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের যে দুটি গ্রুপ বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে তারা খুবই দক্ষ। তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে যেমন ভালো জানে তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশল সম্পর্কেও অবগত। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম। একারণে তাদের ধরতে পুলিশের বিকল্প পথ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আন্ডার কাভার বা স্টিং অপারেশন চালাতে হবে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গি প্রতিরোধে আমাদের কাজ করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। তারা যেমন ‘কুল’ হয়ে কাজ করে, আমাদের তার চেয়েও বেশি ‘কুল’ হয়ে কাজ করতে হবে। ধূমধাম অভিযান চালিয়ে সফলতা হবে না। তারা যে আদর্শ লালন করে, যাদের অনুসরণ করে তার ভেতরে ঢুকতে হবে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সেভাবেই কাজ শুরু করেছে।
গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় জেএমবি: পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর গুলশানে ও শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠে যারা হামলা চালিয়েছে তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবির একটি ভগ্নাংশ। এই গ্রুপটি জেএমবি’র সর্বশেষ আমীর কারাবন্দি মাওলানা সাইদুরকে অস্বীকার করে নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ডাক্তার নজরুল নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে জেএমবি’র এই ভগ্নাংশটি সংগঠিত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে এসব তথ্য মিলেছে। এই গ্রুপটি ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হওয়ার পর থেকেই তারা একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মাওলানা সাইদুরের অনুসারী জেএমবি গ্রুপটি বর্তমানে পুলিশি তৎপরতার কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। কিন্তু ডাক্তার নজরুলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গ্রুপটি প্রথমে উত্তরাঞ্চলে সংগঠিত হয়। এরপর তারা ঢাকার উচ্চবিত্ত শিক্ষিত তরুণদের টার্গেট করে মাঠে নামে। উচ্চবিত্ত তরুণদের অনেকেই আগে হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু হিযবুতের ধীরে চলো নীতি তারা মানতে না পেরে অধিক উগ্রপন্থি দলের সঙ্গে যোগ দেয়। বিশেষ করে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তারা অনুপ্রাণিত হয়। এসব তরুণের অনেকেই সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও অংশ নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইএস নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ দেশে অবস্থান করে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করার নির্দেশনা দেয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তারা দেশে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে।
জঙ্গিরা ব্যবহার করছে উন্নত প্রযুক্তি: গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিরা বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তারা নিত্য-নতুন অ্যাপস ব্যবহার করে। গুলশানের হোলি আর্টিজান রেঁস্তরায় হামলার পরও জঙ্গিরা বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে ছবিগুলো তাদের নিজেদের লোকজনের কাছে পাঠায় বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, জঙ্গিরা সাধারণত মোবাইল ফোন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কমন উপকরণগুলো ব্যবহার করছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগ নজরদারি করে থাকে। কিন্তু জঙ্গিরা ‘প্রটেক্টেড টেক্সট’ ঘরানার এমন কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করে যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারি করতে পারে না। এসব সফটওয়্যার ব্যবহারের সময় সার্ভার পার হওয়ার সময় বার্তাগুলো এনক্রিপ্ট হয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গিদের যোগাযোগের উপকরণ নিয়ে গবেষণা করছে। এসব কিভাবে নজরদারির আওতায় আনা যায় তার কর্ম-কৌশল নির্ধারণ চলছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রয়োজনে এসব উপকরণ নজরদারি করতে বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন করা হবে।
তিন দেশের সহায়তা নিচ্ছে পুলিশ: পুলিশ বলছে, গুলশান ও শোলাকিয়ার সাম্প্রতিক হামলাসহ সাম্প্রতিক জঙ্গি প্রতিরোধে প্রতিবেশী দেশসহ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হবে। বিশেষ করে গুলশানের হামলার ঘটনায় ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য এই সহায়তা নেয়া হবে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গুলশানের হামলার পর অনেক দেশই সহায়তা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ভারত, সিঙ্গাপুর ও আমেরিকার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, গুলশানের ঘটনাসহ সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশের চৌকস, প্রতিভাবান পুলিশ কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তাদের বিদেশি প্রশিক্ষণ রয়েছে। তারা হাইলি কোয়ালিফাইড। কিন্তু কিছু রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য, যেমন ল্যাব পরীক্ষা, এই ধরনের টেকনোলজির আমাদের অভাব রয়েছে। সেই ধরনের পরীক্ষার জন্য কেমিক্যাল এক্সামিনের রিপোর্ট যেখানে ভালো হয় অর্থাৎ সিঙ্গাপুর, ভারত বা ইউএসএ, সেখানে আমরা এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছি। অর্থাৎ কারিগরি সহায়তার জন্য বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তা গ্রহণ করতে পারি।’ এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল ঢাকায় পৌঁছেছে। তবে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা তথ্য দিতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জঙ্গিরা যেসব অ্যাপস ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগ করছে সেসব বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখবে বিদেশি গোয়েন্দারা।
সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রস্তাব ভারতের
পরিতোষ পাল, কলকাতা থেকে জানান, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বাংলাদেশকে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীকে লেখা এক চিঠিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সন্ত্রাস মোকাবিলায় সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে গুলশানে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ভারতের এলিট ন্যাশনাল সিকিউরিটি হার্ড এনএসজির কমান্ডোরা ঢাকা গিয়েছেন বলে মিডিয়াতে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাকে ভুল ও মিথ্যা বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ। তিনি জানিয়েছেন, কমান্ডোরা বাংলাদেশে গিয়েছেন বলে যা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। গত শুক্রবার সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ঘৃণা, হিংসা ও সন্ত্রাসের তাত্ত্বিক হুমকি থেকে দুই দেশের সমাজকে রক্ষা করতে এবং সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে লড়াই করবে। তিনি আরো লিখেছেন, সর্বস্তরে সন্ত্রাস মোকাবিলায় আমাদের সার্বিকভাবে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলা প্রয়োজন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, পবিত্র রমজান মাসে সন্ত্রাসীরা হত্যালীলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই, বিশ্বাস বলে কিছু নেই। সুষমা স্বরাজ আশা প্রকাশ করে লিখেছেন, এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সফর হবে এবং আবার বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এদিকে ভারতীয় ইসলামী ধর্ম প্রচারক ডা. জাকির নায়েকের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের গুলশান হামলার দুজন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে জানানোর পর বাংলাদেশ সরকার এ সম্পর্কে ভারতের কাছে তথ্য চাওয়ার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নড়েচড়ে বসেছে। ইতিমধ্যেই নায়েকের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখার বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তদন্ত শুরু করেছে। জাকির পরিচালিত পিস টিভির সম্প্রচার ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক-দেড় বছর আগে থেকেই জাকিরের উস্কানিমূলক বক্তব্য নিয়ে সরকারকে সতর্ক করলেও এতদিন সরকার এ ব্যাপারে তৎপরতা দেখায়নি। তবে নায়েকের ব্যাপারে বাংলাদেশের বিস্তারিত জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার নায়েকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ভারতের অধিকাংশ ইমাম ও মৌলভীরাও জাকিরের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। ইসলামের নামে তিনি যে সন্ত্রাসের প্ররোচনা দিচ্ছেন তাকে ইসলাম বিরোধী বলে জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছেন ইমামরা।
ঢাকা হামলার পর আবেকে ওবামার চিঠি
গুলশান ক্যাফেতে নিহত জাপানিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের কাছে চিঠি লিখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পরশু পাঠানো ওই চিঠিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাপান, বাংলাদেশ ও বিশ্বের বাকি দেশগুলোর সঙ্গে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়। চিঠিতে ওবামা জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন, মার্কিন জনগণের পক্ষে আমি- ঢাকায় ১-২রা জুলাইয়ের ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলায় নির্মমভাবে নিহত ৭ জাপানি নাগরিকের পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আশা করছি, হামলায় আহত জাপানি নাগরিক দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। এই হামলা আরো বেশি নিষ্ঠুর ছিল এই কারণে যে, আপনার দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ছিল ঢাকায়। ওবামা আরো বলেন, আমি কঠোরতম ভাষায় এতগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া নৃশংস ওই হামলার নিন্দা জানাই।
বাংলায় আইএসের ভিডিও, আরো হামলার হুমকি
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এতে, কথা বলতে দেখা যায় আইএসে যোগ দেয়া বাংলাদেশি ৩ যুবককে। তারা হলি আর্টিজানে হামলার প্রশংসা করে আরো হামলার হুমকি দেয়া হয়। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর অনলাইন তৎপরতা নজরদারি করা মার্কিন সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ মঙ্গলবার ভিডিওটি প্রথম প্রকাশ করে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে আইএসের ভিডিওতে কথা বলা ২ বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছেন। এদের একজন ছিলেন গায়ক (তাহমিদ রহমান শাফি), একজন ডেন্টিস্ট (তুষার)। ভিডিওতে দেখা যায়, কোনো একটি বিদেশি শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
প্রায় ৬ মিনিট দীর্ঘ ওই ভিডিওর শুরুতেই দেখানো হয়, ঢাকাসহ বিশ্বব্যাপী আইএসের দাবি করা হামলার নিয়ে প্রচারিত টিভি সংবাদের ক্লিপ। ব্যাকগ্রাউন্ডে চলছিল আরবী ভাষার একটি গান যা আইএসের বিভিন্ন ভিডিওতে আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। এরপরই এক যুবক বাংলায় বক্তব্য দেয়া শুরু করে। তার পরনে ছিল শার্ট। কাঁধে ব্যাগ। বাংলাদেশ সরকার ও কর্মচারীদের হুমকি দিয়ে সে বলছিল, এবার তারা যে ‘জিহাদ’ প্রত্যক্ষ করেছে সেটা আগে কখনও দেখেনি। ভবিষ্যতে আরো হামলা হবে বলে হুমকি দেয় সে। শেষ অংশে সে ইংরেজিতে বার্তা দেয় ‘ক্রসেডার’দের উদ্দেশ্যে। বক্তব্যে ক্যাফে হামলার ঘটনাকে ‘গতকালের’ হামলা বলে উল্লেখ করে ওই যুবক। ফলে ধারণা করা হচ্ছে ভিডিওটি হামলার পরদিন ধারণ করা। তার বক্তব্যের পর আরো দুজন যুবক বক্তব্য দেয় বাংলায়। ২য় ব্যক্তি ছিল পাঞ্জাবি পরা। তার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। ভিডিও’র শেষের বক্তা ছিল টি-শার্ট পড়া। মুখে দাড়ি। মাথায় কালো টুপি এবং কাঁধে ব্যাগ। সে গুলশান হামলাকারীদের প্রশংসা করছিল।
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর ইতিমধ্যে অনেকে তাদের চিনতে পেরেছেন। তাদের পরিচয়ও সামনে এসেছে। তিনজনের মধ্যে অন্তত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভিডিওর প্রথম বক্তার নাম তাহমিদ রহমান শাফি। সে একজন সঙ্গিতশিল্পী ছিল। ক্লোজআপ ওয়ানের প্রথম আসরে সে শীর্ষ ১৫ জনের মধ্যে ছিল। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে এক সময় গ্রামীণ ফোনে কাজ করতো সে। তাহমিদ সাবেক নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমানের ছেলে বলে জানিয়েছেন তার সহপাঠীরা। বছর খানেক আগে সে সস্ত্রীক তুরস্ক চলে যায়। দ্বিতীয় যুবকের নাম তুষার। সে প্রয়াত মেজর ওয়াশিকুর আজাদের ছেলে। সে পেশায় ডেন্টিস্ট ছিল। আনুমানিক বছর দুই ধরে নিখোঁজ।
নিসা দেশাই ঢাকা আসছেন আজ
গুলশানে রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার পর আনুষ্ঠানিক দুদিনের সফরে আজ ঢাকা আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়াল। সফরকালে নিশা দেশাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ছাড়াও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, রেস্তোরাঁয় হামলা তদন্তে সহায়তায় মার্কিন প্রস্তাব এবং মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। এছাড়া সফরে সামপ্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনাসহ কিছুদিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় মার্কিন মিশনের সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানসহ দু’জনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। প্রসঙ্গত, জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের পর ৫ই মে নিশা বিসওয়াল জরুরি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।