কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়াও করেছে তারা। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এসব কিছু ছেড়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সন্ধান করা হয় পরিচিত, আত্মীয়স্বজনের বাসায়। কোথাও কোনো সন্ধান মিলেনি। এমনকি কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। তবুও হদিস মিলেনি তাদের। গুলশানে জিম্মি সংকটের রক্তাক্ত অবসান হওয়ার পর ছয় তরুণের লাশ পাওয়া যায়। তারাই হামলাকারী জানিয়ে তাদের লাশের ছবি প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইভাবে কালো পাঞ্জাবি ও মাথায় কাপড় বাঁধা, অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হাস্যোজ্জ্বল পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে আইএস। মুহূর্তের মধ্যেই ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শনাক্ত হয় তাদের পরিচয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিহতদের মধ্যে পাঁচ তরুণের নাম জানিয়েছে আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন। তাদের স্বজনরা জানান, প্রকাশিত ছবির তরুণদের মধ্যে চারজন হচ্ছেন- রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামিহ মোবাশ্বির, নিবরাস ইসলাম ও আন্দালিব রহমান।
মোহাম্মদপুর এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান রোহান ইমতিয়াজ। তার পিতা আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুল। তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপ-মহাসচিব ও আওয়ামী লীগের মহানগরের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের ই ব্লকের বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতো সে। এছাড়া, তাদের আরো একটি বাসা রয়েছে লালমাটিয়ায় বি ব্লকে। রোহান ইমতিয়াজের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার হরিহরনগরে।
পুলিশ ও রোহানের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-তে পড়তো রোহান ইবনে ইমতিয়াজ। গত বছরের ৩০শে ডিসেম্বর বাসা থেকে বের হয়ে যায় সে। তারপর থেকে আর তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এসময় চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিলেন তার মা-বাবা। দেশে ফিরে থানায় জিডি করেন তার পিতা বাবুল।
প্রতিবেশীরা জানান, রোহান নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানতেন তারা। রোহানের পিতা ছেলেকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। একই মহল্লার তার সমবয়সী এক তরুণ জানান, গত বছরের নভেম্বর থেকেই তাদের সঙ্গে চলাফেরা কমিয়ে দেন রোহান। এসময় থেকেই পাশের মসজিদে প্রায়ই নামাজ পড়তে যেতো। রোহান ভদ্র, নম্র ছিল বলে তার পরিচিতজনরা দাবি করেন। তার ছবি দেখে ওই এলাকার মানুষ আঁতকে উঠেছেন। এ বিষয়ে রোহানের পিতা আওয়ামী লীগ নেতা এসএম ইমতিয়াজের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তার বাংলালিংক নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি তার স্বজনদের কেউ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি। প্রতিবেশী মোহাম্মদ শামীম বলেন, ইমতিয়াজ বাবুলের ছেলে নিখোঁজ হয়েছে জানতাম। জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তা জানা ছিল না। গণমাধ্যমে তার ছবি দেখে আমরা অবাক হয়েছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এস এম ইমতিয়াজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, রোহান নিখোঁজ হওয়ার পর গত ৪ঠা জানুয়ারি মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তার পিতা বাবুল। নিখোঁজ হওয়ার পর র্যাব-পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছে তাকে উদ্ধার করতে। এমনকি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা চেয়েছিলেন ইমতিয়াজ খান বাবুল। ছেলেকে ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও যান তিনি। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, রোহান দেশে নেই বলে ধারণা করছেন তারা।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর মানবজমিনকে বলেন, জিডির পর থেকেই বিষয়টি গুরুত্বসহ তদন্ত করেছে পুলিশ। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার ও অনুসন্ধান চালিয়ে এক পর্যায়ে পুলিশ ধারণা করে রোহান জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত। কিন্তু তাকে আটক করা যাচ্ছিলো না। তবে যাতে দেশ ছাড়তে না পারে এ জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে রোহান দেশের বাইরে গিয়েছিলো কি-না এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত না বলে জানান।
নিহতদের আরেকজন নিবরাস ইসলাম। ওয়ারী ও উত্তরায় দুটি বাসা রয়েছে তাদের। তার বন্ধুরা জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেসের কোষাধ্যক্ষ ছিল সে। তার আগে ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। মালয়েশিয়ায় ভালো লাগেনি তার। ফিরে আসে দেশে। ভর্তি হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় সে। তার বন্ধুদের দেয়া তথ্যমতে, ওয়ারি আর উত্তরায় বাড়ি আছে তার ব্যবসায়ী পিতার। তার তিন চাচার মধ্যে একজন সরকারের উপ-সচিব, একজন পুলিশের এএসপি, আরেকজন বিজ্ঞানী।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিবরাস ইসলাম এই নামে তার একটি আইডি পাওয়া গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বন্ধুরা জানান, ২০১২ পর্যন্ত নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে নিবরাস। গত জানুয়ারি থেকেই নিখোঁজ। নিরবাসের কোনো সন্ধান পাননি তার বন্ধুরা। আইএসের দেয়া ছবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া লাশের ছবি দেখে চমকে গেছেন তার বন্ধুরা। নিবরাসের ফেসবুকে দেখা গেছে, গত জানুয়ারিতে লিখেছে ‘অল দ্যা পিপল ডায়িং ইন দ্যা মিডল ইস্ট অ্যান্ড ইন আফ্রিক।’
গত বছরের ২রা নভেম্বর তার মায়ের একটি ছবি পোস্ট করে নিবরাস লিখেছে, ‘তুমি আমার জন্য যা করেছো সবই আমি ভালোবাসি। তোমার প্রত্যেক সমস্যা আমার জন্য। আমার খুব ইচ্ছে করে আমি যদি তোমার পাশে থাকতে পারতাম। তোমাকে এখন আমার খুব প্রয়োজন। আমি তোমাকে ভালোবাসি আম্মু।’ গুলশানের হামলার ঘটনার পর ফেসবুকে তার বন্ধু লিখেছে, নিবরাস ফুটবল খেলা পছন্দ করতো। বিতর্ক করতো। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য ছিল সে। একসঙ্গে অনেক ইভেন্টে কাজ করেছে তারা। কিন্তু নিবরাস কিভাবে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হলো তা ভেবে পাচ্ছে না তার বন্ধুরা। ফেসবুকে শৈশব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের ছবি রয়েছে নিবরাসের। ফুটবল খেলার ছবিও রয়েছে ওই আইডিতে।
গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিল সামিহ মোবাশ্বির। ওই দিন বিকাল ৩টার দিকে মীর সামিহ মোবাশ্বির কোচিংয়ে যাওয়ার উদ্দেশে গাড়িতে করে বনানীর বাসা থেকে বের হয়। যানজট থাকায় কোচিং সেন্টারের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যায় সে। পরে সন্ধ্যায় গাড়িচালক জুয়েল তাকে কোচিং থেকে আনতে গেলে তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে মোবাশ্বিরের বাবা মীর এ হায়াত কবীর ওই দিনই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১৮৪৮) করেন। পুলিশ ওই সময়ে তার স্বজনদের জানায়, সামিহ’র খোঁজ করতে গিয়ে গুলশান এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সামিহ গাড়ি থেকে নামার পর একটি রিকশা নিয়ে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের দিকে চলে যায়। নিখোঁজের পর থেকে তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। নিখোঁজের সময় তার ও লেভেল পরীক্ষা চলছিলো।
তার পিতা মীর হায়াত কবির অ্যালকাটেল-লুসেন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তা। মা খালেদা পারভীন সরকারি কলেজের শিক্ষক। বড় ভাই পড়ছেন কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিহত আরেকজনের নাম আন্দালিব আহমেদ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে তার ছবি প্রকাশ করে তাকে আন্দালিব রহমান বলে দাবি করেছে তার বন্ধুরা। মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে সেও পড়ালেখা করতো। তার আগে আন্দালিব পড়েছে ঢাকার নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল সানিডেলে। সেও নিখোঁজ ছিল বলে তার বন্ধুরা দাবি করেছেন।