মো. মনুসর আলী জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন ২০০৮ সালে। প্রায় সাত বছর আগে নেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্মসাল ১৯৩৮। সম্প্রতি তিনি তা সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন। মাত্র ২১ বছর বয়স কমিয়ে (!) তিনি চাইছেন তার জন্মসাল ১৯৫৯ করতে। তাহমিনা খানম হতে চান লাইলী বেগম। নাছরিন আক্তার শিমুল তার জাতীয় পরিচয়পত্রে মায়ের নাম জয়সন বেগমের পরিবর্তে করতে চাইছেন রোজিনা বেগম। কার্তিক চন্দ্র বেপারী হতে চান ধীরেন্দ্রনাথ বেপারী। আর একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ দেখা সড়ক বিভাগের এক কর্মচারী নাকি জন্ম নিয়েছেন ১৯৮৩ সালে। তাই জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা জন্মসাল ১৯৬৬ ‘সংশোধন’ করে ১৯৮৩ করতে চাইছেন তিনি। এরকম হাজার হাজার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনীর নথি এখন নির্বাচন কমিশন অফিসারদের টেবিলে। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল ঘোষণার পর রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনু বিভাগে এসে অনেকেই চেষ্টা করছেন তথ্য সংশোধন করার।
নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন এখানে ভিড় করা হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই আসেন অন্যায় আবদার ও অভিযোগ নিয়ে। একটি দালাল চক্রও গড়ে উঠেছে_ যারা উস্কে দিচ্ছে এরকম আবেদনকারীদের।
নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ এ সম্পর্কে বলেন, ‘ঢালাওভাবে অভিযোগ করলে সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। ভোগান্তি হলে তথ্যনির্ভর অভিযোগ করতে হবে। একজন অন্যায় আবদার নিয়ে আসবেন আর আমাদের কর্মকর্তারা তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই করে দেবেন_ এমনটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। কারণ এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। কেউ একজন নাম বা বয়স পরিবর্তন করে আর্থিক জালিয়াতি করতে পারেন। সম্পত্তি-সংক্রান্ত জালিয়াতি করতে পারেন। কোনো বড় অপরাধী এরকম করে পার পেয়ে যেতে পারেন। তাই সঠিক তথ্য যাচাই ও প্রমাণ ছাড়া কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন না করার জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা আছে।’
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন করে বেতন স্কেল ঘোষণা করার পর থেকে এমন সব অদ্ভুত সংশোধনীর নথি আসতে শুরু করেছে। এসব ফাইল দেখেই বাতিল করা যায়। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সময় নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে তদন্তে দেখা যাচ্ছে, এসবের প্রায় শতভাগ অভিযোগেই তথ্যের গরমিল রয়েছে। তদন্তে যার উত্তর মিলছে না। কিছু আছে যা প্রকৃতই সংশোধনযোগ্য। সেগুলো দ্রততার সঙ্গেই করা হচ্ছে। কর্মকর্তাদের দাবি, ‘ভোগান্তি’ বলে যারা অভিযোগ করেন, তারা তাদের অন্যায় আবদার না রাখার কারণেই করে থাকেন।
ঢাকা উত্তরা থানা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজালালের সঙ্গে সংশোধনীতে ভোগান্তির অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি তার টেবিলে রাখা সব ফাইল এ প্রতিবেদকের দিকে ঠিলে দিয়ে বলেন, ‘আপনি একটু কষ্ট করে চা খেতে খেতে দেখেন এগুলোর বিষয়ে কী করার আছে।’ একটি ফাইল হাতে তুলে দেখা যায়, তাতে শহিদ আহমেদ জুয়েল নামের এক ব্যক্তি মো. জুয়ের মিয়া হিসেবে নিজের নাম সংশোধন করার আবেদন করেছেন। তিনি মাধ্যমিক পাস। কিন্তু সংশোধনীর সময় একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ বাদে আর কোনো প্রমাণপত্র দেননি। একই পরিস্থিতি নাসরিন আক্তারের। তিনি হতে চান নাসরীন হোসাইন। উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ নাসরীন দিয়েছেন জন্ম নিবন্ধন সনদ। তাই তাদের সংশোধনীর আবেদন নিচ্ছেন না নির্বাচন কমিশন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় অনেকেই বয়স কম উল্লেখ করেছেন। অনেকে ভুয়া সার্টিফিকেটে চাকরি করছেন। এখন বেতন-ভাতা ও পেনশন সুবিধা স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফিক্সেশন করতে হচ্ছে। সেখানে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে তথ্যের ব্যাপক গরমিল হচ্ছে। তাই নানা কৌশলে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে।
গত বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় আগারগাঁও গিয়ে দেখা যায়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনের সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। দুইশ’ মিটারের যানজট ছুটতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। কারণ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভবনেই জাতীয় পরিচয়পত্র অনু বিভাগের অফিস। ভবনের সামনে থেকে সাততলা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের ভিড়।
তাদের একজন সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি এসেছেন তার জন্ম তারিখ পরিবর্তন করতে। কিন্তু বারবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার হাতের কাগজপত্র নিয়ে দেখা গেল, তিনি তার বয়স প্রমাণের জন্য এসএসসির সনদের কপি সংযুক্ত করেননি। সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে দীর্ঘসময় ধরে আলাপের এক পর্যায়ে সাইদুল স্বীকার করেন, তিনি মাধ্যমিকের পরে আর পড়ালেখা করেননি। তবে সাইদুল ইসলাম নামের অপর একজনের কাছ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের সনদ নিয়ে সরকারি চাকরি করছেন। ফলে ওই সনদ অনুযায়ী তাকে জন্ম তারিখ ঠিক করতে হবে।
নোয়াখালী থেকে এসেছেন জ্যোৎস্না বেগম। তিনি এসেছেন তার বয়স মাত্র ছয় বছর বাড়ানোর আবেদন নিয়ে। নিজেকে ‘অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ’ দাবি করে জ্যোৎস্না জানান, বেতন পাওয়ার জন্য তাকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতেই হবে। উত্তরার লিয়াকত হোসেন খান নামে জাতীয় পরিচয়পত্রে স্বাক্ষর করা এক ব্যক্তি তথ্য পুরোপরি বদলে এখন চান মাসুদ রানা হতে। কামরুল ইসলাম চান তার বয়স আট বছর বাড়াতে।
ইসির জনসংযোগ শাখার পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান জানান, ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র না হলে এসব ব্যক্তি তথ্য গোপন করে নতুন করে নিবন্ধনের সুযোগ নিতেন। এখন তাদের আঙুলের চারটি ছাপ থাকায় নাম এদিক-সেদিক করে তথ্য গোপন রেখে ফের নিবন্ধিত হওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। এক ব্যক্তি দুইবার নিবন্ধিত হতে গেলে সার্ভারে তাদের তথ্য চলে আসে। ফলে সংশোধনের জন্য আসা মানুষের ভিড় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন একটু বেশিই।