প্রতিদিনই কমছে কৃষি জমি। সংশ্লিষ্টরা মুখে এর সুরক্ষার কথা বলছেন; কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক উল্টো। তাই কৃষি জমির অপরিকল্পিত ব্যবহার রোধে ২০০৯ সালে আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার পর সাত বছর কেটে গেছে। কিন্তু সেটি চূড়ান্ত করতে পারছে না ভূমি মন্ত্রণালয়। কৃষি জমির সুরক্ষায় ও ভূমির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে আইনের খসড়া করার পর মন্ত্রণালয় বাধার মুখে পড়ে। খসড়া আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় দেশের একটি প্রভাবশালী মহল। তাদের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে আইনের বিরোধিতা করে মন্ত্রীকে বলা হয়, আইনটি প্রণয়ন হলে কলকারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন। এভাবে আটকে যায় আইন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত তা প্রণয়ন করা যাবে কি-না কিংবা প্রণীত হলেও তা কতটুকু সময়োপযোগী ও কার্যকর হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে যথেষ্ট সংশয়।
অথচ আইনটির খসড়া করতে গিয়ে এর মধ্যেই প্রায় কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, এ আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মতামত সঠিক সময়ে না পাওয়ায় এটি প্রণয়নে দেরি হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন ও ভূমি ব্যবস্থা আইন একই রকম হওয়ায় দুটোকে একসঙ্গে প্রণয়ন করা হবে কি-না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।
এ ব্যাপারে ভূমি সচিব মেজবাউল আলম বলেন, ‘কৃষি জমি সুরক্ষায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভূমি ব্যবহার আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইনটি প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। সবার মতামতের ভিত্তিতেই এ আইন প্রণয়ন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আইনে কোন জমি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে। তবে এ আইনে কৃষি জমি সংরক্ষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বাধিক ও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, ততদিন আইনটি প্রণয়ন সম্ভব হবে না। আইন হলে কিছু মানুষের অসুবিধা হবেই; কিন্তু তাদের রক্ষার চেয়ে দেশের সম্পদের সুরক্ষা ও সুষ্ঠু ব্যবহারই বড়, এটি আইনপ্রণেতাদের মনে রাখতে হবে।’ তারা জানান, ‘আইন তৈরি করতে গিয়ে যাদের স্বার্থ দেখা হচ্ছে, তাদের কারণেই আজ দেশের কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে।’
নীতিমালা থাকলেও শাস্তির বিধান নেই: বর্তমানে দেশে ভূমি ব্যবহার নীতিমালা থাকলেও কোনো আইন নেই। বিদ্যমান নীতিমালায় শুধু এই নির্দেশনা রয়েছে যে, কোন ক্ষেত্রে কৃষি জমি ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু কৃষি জমির অপব্যবহারে কোনো শাস্তির বিধান নেই। ফলে কেউ এই নীতিমালা মানছেন না। কৃষি জমি নষ্ট করে গৃহায়ণ প্রকল্প, বসতভিটা, কলকারখানা, স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। এতে প্রতিবছরই কমছে কৃষি জমি। খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। দেশ অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। আবার কৃষিজমি সুরক্ষার প্রচলিত ধারণাতে রাসায়নিক ও অন্যান্য দূষণজনিত কারণ থেকে রক্ষার চিন্তা নেই। বিভিন্ন প্রকল্প বা উদ্যোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন হলেও কৃষি ও ফসলি জমির কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি-না, সে ব্যাপারে ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ও কৃষি জমি সংরক্ষণে সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়; কিন্তু সাত বছরেও আইনটি প্রণয়ন হয়নি।
মাথাপিছু ও আবাদি জমি কমছে: বর্তমানে ১৪.৪ মিলিয়ন হেক্টরের বাংলাদেশে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মানুষের বাস। সে হিসাবে জনপ্রতি মোট ভূমির পরিমাণ গড়ে ২৪ শতাংশ এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১৫ শতাংশ। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ জনসংখ্যা বাড়ছে। যে কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণও কমছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নগরায়নের প্রবণতা বাড়ছে, শিল্পোন্নয়ন ঘটছে। এতেও জমির পরিমাণ কমে আসছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২০.২ মিলিয়ন একর। এখন তা কমে হয়েছে ১৭.৫ মিলিয়ন একর। এ কারণে প্রতিবছর খাদ্যশস্যের আমদানি বাড়ছে। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, আশির দশকে যে ভূমির প্রায় ১৫ ভাগ কৃষক ও গ্রামবাসী বসতভিটা ও অকৃষি কাজে ব্যবহার করতেন, এখন একই কাজে সেই জমির ৩০ ভাগ ব্যবহার করছেন। এভাবে প্রতিবছর কমছে প্রায় দুই লাখ একর কৃষি জমি। বর্তমানে দেশে সরকারের হাতে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ একর খাস কৃষি জমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় তিন লাখ একর জমিই চলে গেছে অবৈধ দখলে। ৬০ হাজার একর জমি মামলা করে দখলে রেখেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল জোনের অধিকাংশ জমি এবং পূর্বাঞ্চল জোনের অনেক জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের ভাওয়াল রাজ ও কোর্ট অব ওয়ার্ডসের প্রায় সব জমি এখন অবৈধ দখলে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার শত শত পাহাড় ভূমিদস্যুরা দখল করে কেটে প্রতিবেশকে ভারসাম্যহীন করছে।
খসড়া আইন যেভাবে আটকে গেল: মূলত পাহাড় কাটা বন্ধ ও দখল হওয়া কৃষি জমি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করে সংরক্ষণ করতেই ২০০৯ সালে ভূমি ব্যবহার আইন করার উদ্যোগ নেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রণীত খসড়া আইনে বিধান রাখা হয়, কেউ কৃষি জমি নষ্ট করে বসতভিটা, শিল্পকারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবেন না। এমনকি নিজের জমিতে ইমারত নির্মাণেও সরকারের অনুমতি নেওয়া লাগবে। কেউ এ আইন অমান্য করলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা আর্থিক দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইন তৈরিতে একজন পরামর্শকও নিয়োগ করা হয়। আইনটি তৈরির লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় সভা-সেমিনার করা হয়। প্রায় তিন বছরের প্রচেষ্টায় ২০১২ সালে আইনটির খসড়া তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়। তখনই আসে বিপত্তি। একটি প্রভাবশালী মহল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওই সময়ের মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে খসড়া আইনের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন, এভাবে আইন প্রণয়ন করলে কলকারখানা স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা হবে। দেশে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া থেমে যায়।
পরে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে খসড়া আইনের কয়েকটি বিধান শীতল করে একটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তার পরও তা চূড়ান্ত হয়নি।