অভিজিৎ হত্যায় সন্দেহভাজন শরিফ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

129359_315

রাজধানীর খিলগাঁওয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক যুবক নিহত হয়েছে। প্রথমে অজ্ঞাত থাকলেও পরে তার পরিচয় প্রকাশ করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, বন্দুকযুদ্ধে নিহত ওই যুবক ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন আসামি শরিফ। অভিজিৎ হত্যা তদন্তে সিসিটিভির ফুটেজে শরিফুলের উপস্থিতি ধরা পড়েছে বলেও তারা জানিয়েছে।
নিহত শরিফুল একাধিক নামে পরিচিত। যেমন: সাকিব ওরফে শরীফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদি। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক ও আইটি শাখার প্রধান ছিলেন বলে বলা হচ্ছে। তাকেসহ ছয় জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে সম্প্রতি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পুরস্কার ঘোষণার প্রায় এক মাসের মাথায় গত শনিবার দিবাগত রাতে খিলগাঁও মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় ডিবির একটি টিমের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় শরিফুল। পরে লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর তার পরিচয় প্রকাশ করে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, মোটরসাইকেল ও গুলি উদ্ধারের দাবি জানিয়েছে ডিবি। তালিকাভুক্তদের মধ্যে ১ নম্বরে ছিল নিহত শরিফের ছবি। তাকে ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। এ দিকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত নিহত শরীফের লাশ নেয়ার জন্য কোনো স্বজন মর্গে আসেনি। গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, শুধু অভিজিৎ নয়, ব্লগার নিলয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নাজিমউদ্দীন সামাদ, সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী তনয় হত্যাসহ ৭ মামলায় শরিফ সম্পৃক্ত ছিল।
পুলিশের দাবি, দু’দিন আগে প্রকাশক টুটুল হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেফতার শিহাবের দেয়া তথ্যে অভিযানে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে শরিফুল নিহত হয়। উল্লেখ্য গত সপ্তাহে কামরাঙ্গীর চর থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য শিহাব পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, পুরস্কার ঘোষিত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরীফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদি-১ খিলগাঁওয়ে অবস্থান করছে এমন সংবাদে ডিবি (দক্ষিণ) এর একটি টিম শনিবার রাত ২টার দিকে মেরাদিয়ার বাঁশপট্টি এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজনকে যেতে দেখে তাদের থামতে সঙ্কেত দেয়। কিন্তু মোটরসাইকেল না থামালে পুলিশের সন্দেহ হয়। মোটরসাইকেলের তিন আরোহীকে ধাওয়া করে পুলিশ। মোটরসাইকেলের আরোহীরা ডিবিকে ল্য করে গুলি ছোড়ে। ডিবিও পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে মোটরসাইকেলের দুই আরোহী পালিয়ে যায়। একজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরীা শেষে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
তিনি আরো জানান, প্রথমে শরীফের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার চেহারার সাথে ডিএমপির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা ছয়জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যের মধ্যে চিহ্নিত জঙ্গি শরিফুলের চেহারার সাথে মিল পেয়ে পুলিশ তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
যুগ্ম কমিশনার দাবি করেন, নিহত শরিফ নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুলাহ বাংলা টিমের সামরিক ও আইটি শাখার শীর্ষ পর্যায়ের একজন প্রশিক ছিল। অভিজিৎ রায়সহ সাতটি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সে জড়িত। এর মধ্যে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় শরীফ। এ ছাড়া বিভিন্ন অপারেশনের সদস্য নির্বাচন ও সংগ্রহে সে প্রধান ভূমিকা পালন করত। নীলাদ্রী নীলয়, শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ মোর্শেদ বাবু, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নাজিমউদ্দিন সামাদ, জুলহাজ মান্নান ও তনয় হত্যা এবং প্রকাশক আহম্মেদ রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ছিল শরিফ। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় শরিফুল ঘটনাস্থলে ছিল এবং ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে তার চেহারা স্পষ্ট দেখা গেছে। টার্গেট কিলিংয়ে অংশ নেয়া জঙ্গিদের শরিফ রিক্রুট করে প্রশিণ দিয়েছে। সে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। আগের গ্রেফতারকৃত জঙ্গিরা বিভিন্ন সময় জিজ্ঞাসাবাদে শরিফুলের নাম বলেছে।
অভিজিৎ রায় হত্যায় শরিফ জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া প্রসঙ্গে আব্দুল বাতেন বলেন, আমরা টিএসসির ভিডিও ফুটেজ মিলিয়ে দেখেছি। তা ছাড়া আমাদের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল শরিফ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। তার গ্রামের বাড়ি সাতীরায়। বন্দুকযুদ্ধের পর ওই সব তথ্য মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, শরিফ অভিজিতের হত্যাকারী।
অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে তার কী কী ভূমিকা ছিল? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে আব্দুল বাতেন বলেন, সে মূলত পরিকল্পনাকারী ও প্রশিক। জুলহাজ ও তনয় হত্যাকাণ্ডে তার টিম অংশ নিয়েছিল। ওয়াশিকুরের ঘটনায় শরিফের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা, ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা এবং গত দুই মাসে সূত্রাপুরে সংঘটিত
ব্লগার নাজিমউদ্দিন সামাদ, কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান ও তনয় হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবেও তার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে প্রতিটি ঘটনায় তার সরাসরি উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
বন্দুকযুদ্ধে শরিফ মারা যাওয়ায় তদন্তে কোনো প্রভাব পড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম-কমিশনার বলেন, বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার প্রধান আসামি ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির মৃত্যুতে মামলা তদন্তে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। তবে এসব আসামি দিয়ে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দী দেয়াতে পারলে মামলার জন্য ভালো হতো।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযানে গিয়ে পর্যাপ্ত সতর্ক না থাকলে কী ঘটনা ঘটে তা আপনাদের জানা আছে। আমাদের একজন পুলিশ সদস্য এর আগে অভিযানে গিয়ে মারা গেছেন। আমাদের ওপর কেউ হামলা করে, যদি খুন করে যায়, তা আইন পারমিট করে না। জানমালের নিরাপত্তা দেয়াও আমাদের দায়িত্ব। আত্মরার্থে পুলিশ তার সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করে। তখন প্রাণহানি ঘটে। বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে আগে থাকতেই কিছু বলা যায় না। অভিযানে গিয়ে পুলিশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়।
তিনি বলেন, পুলিশ আত্মরার্থে গুলি চালায়। তখন এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এসব আসামি বেঁচে থাকলে তদন্তে সুবিধা হতো। তাদের দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ানো যেত। তবে আমার মনে হয় না, এতে মামলার তদন্তে বড় কোনো সমস্যা হবে। কারণ অন্যান্য আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দীর ভিত্তিতে মামলার তদন্ত এগিয়ে চলে।
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বের হলে কয়েক যুবক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। এই হামলায় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও আহত হন। অভিজিৎ ‘মুক্তমনা’ নামে একটি বাংলা ব্লগ পরিচালনা করতেন। তার লেখালেখির বিষয় ছিল বিজ্ঞান। ওই ঘটনায় আটক হওয়ার পরপরই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) নেতা তৌহিদ ও বাশারসহ ছয় জঙ্গি অভিজিৎ হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে র‌্যাব দাবি করলেও ডিবির রিমান্ডে তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে ফারাবী নামে এক ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে কয়েক দফা জিজ্ঞাসায় তার জড়িত থাকার কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় এরই মধ্যে এবিটির নেতা তৌহিদসহ তিনজনকে আটক করে র‌্যাব। পরে আটক করে এবিটি প্রধান মুফতি রাহমানীর ছোট ভাই আবুল বাশারসহ আরো তিনজনকে। সে সময় র‌্যাব দাবি করেছিল তারা সবাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। গত মার্চে ড. অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত হিসেবে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সাত জঙ্গিকে শনাক্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। কারাগারে থাকা অন্য আট জঙ্গির ডিএনএ নমুনা পরীা-নিরীার জন্য সিআইডি ল্যাবে পাঠানোর কথাও জানানো হয়।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *