জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে গত তিনদিনে গ্রেপ্তার ছাড়িয়েছে ৮ হাজারেরও বেশি। অতিরিক্ত বন্দিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সারা দেশের ৬৮ কারাগার উপচে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এমনিতেই কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চাইতে দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে। তারপর আবার দুই দফা বিশেষ অভিযানের নামে একসঙ্গে এত লোক গ্রেপ্তারে কারাগারগুলোতে করুণ অবস্থা বিরজা করছে। প্রথম দফায় গত ৬ থেকে ১৩ই জুন পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ই জুন থেকে শুরু হয়েছে জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান। অভিযানে মাত্র শতাধিক ‘জঙ্গি’ গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিরা সবাই অন্যান্য পেন্ডিং মামলা ও নিয়মিত মামলার আসামি। কারাসূত্র জানায়, গত রোববারের হিসাব অনুযায়ী কারাগারে ৭৩ হাজারেরও বেশি বন্দি ছিল। গতকাল এই সংখ্যা আরো অন্তত দুহাজার বেশি হয়েছে। অথচ দেশের ৬৮ কারাগারের ধারণক্ষমতা মাত্র ৩৪ হাজার ৬৮১ জনের। সেই হিসেবে বর্তমানে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৪০ হাজার বেশি বন্দি রয়েছে কারাগারগুলোতে। সূত্র বলছে, ধারণক্ষমতার চাইতে দ্বিগুণেরও বেশি বন্দি হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে বন্দিদের। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কারাগারে বন্দিদের যে অধিকার তা প্রতিপালন করা না হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বর্তমানে কারাগারগুলোতে সেই অবস্থাই চলছে। জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তাদের কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊধ্বর্তন কারা কর্মকর্তা জানান, আমরা এমনিতেই দ্বিগুণ বন্দি ধারণ করছি। বিশেষ অভিযানের গ্রেপ্তারের ফলে চাপ তো বাড়ছেই। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আসামি কারাগারে পাঠালে আমাদের ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। আমাদের যে কোনো উপায়ে তা ‘কনজিউম’ করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ঠাঁই নাই অবস্থা হয়েছে দেশের কারাগারগুলোতে। বিশেষ অভিযানের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ধরপাকড়েরর অভিযোগ উঠেছে এর মধ্যেই। ফলে বন্দিতে ঠাসা হয়ে উঠেছে কারাগারগুলো। প্রায় আড়াইগুণ বেশি বন্দি সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। তীব্র গরমে কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের দুর্দশা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাড়ছে গরমজনিত নানা রোগব্যাধি। চিকিৎসাও মিলছে না যথাযথ। অনেকটা মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কারাগারগুলোতে।
কারাসূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে বন্দি ধারণক্ষমতা মাত্র ২ হাজার ৬৮২ জন। গতকালও এই কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৭ হাজারেরও বেশি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের কারণে পূর্বের চাইতে চাপ কিছুটা বেড়েছে সত্যি। তারা বিভিন্ন কৌশলে বাড়তি চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন। জেলাসহ অন্য কারাগারগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে বন্দির চাপে রীতিমতো যাচ্ছেতাই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কারাসূত্র জানায়, সারা দেশে ছোট বড় ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীনেই কাশিমপুরে দুটি হাই সিকিউরিটি সেল রয়েছে। বাকি ৫৫টি বিভিন্ন কারাগার রয়েছে বিভিন্ন জেলা সদরে। জেলা কারাগারগুলো আয়তন ও ধারণক্ষমতায় অনেক ছোট। গণগ্রেপ্তারের ফলে এসব কারাগারের অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ ও জঙ্গিবিরোধী দুই দফা অভিযানে সারা দেশে ধরপাকড় চলছে। ফলে দেশের কারাগারগুলোর নির্ধারিত সেলগুলোতে বন্দিদের ঠাঁই দিতে পারছে না বন্দিদের। বাধ্য হয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কারাভ্যন্তরের বিভিন্ন গোডাউন, বড় সেলের বারান্দা, এমনকি যেসব সেলের বাথরুমগুলো বড়- সেগুলোকেও পরিবর্তন করে সেল বানানো হয়েছে। এরপরও গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে বন্দিদের। মাঝে মধ্যেই এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বন্দিদের অদল-বদল করে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে। বন্দির সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলে কারাগারের ভেতরে পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন কারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষ বলছেন, এক্ষেত্রে তাদের কিছুই করার নেই। আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো আসামি তারা কখনোই ফেরত পাঠাতে পারেন না। যে কোনোভাবেই তাদের কারাগারের ভেতরে রাখতে হয়।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘কারাগারগুলোতে এমনিতেই বাড়তি চাপ রয়েছে। কারাবন্দিদের সুযোগ-সুবিধাও খুব ক্ষীণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অমানবিকও। তার ওপর এই সংখ্যা চাপ আরো বাড়বে যে এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই পরিচালক বলেন, ‘বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা এখন যা আছে তার চাপ সামলানো হয়তো সম্ভব হবে। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে বা গ্রেপ্তারের সংখ্যা যদি ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায় তাতে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় হতে পারে।’
সূত্র জানায়, নিয়মিত গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বেশি বেশি মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সকল মেট্রোপলিটন এলাকা ও জেলাগুলোতেও পরিচালনা করা হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে সরাসরি জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এতেও কারাগারের ওপর চাপ বাড়ছে। কারণ নিয়মিত মামলার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে গেলেও মোবাইল কোর্টের স্বল্প সময়ের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা বন্দি হিসেবেই ভেতরে থাকছেন। এ কারণে চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।