গ্রাম বাংলা ডেস্ক: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনতা ব্যাংকের বিদায়ী চেয়ারম্যান আবুল বারকাত। অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, তদবিরের অভিযোগ তোলার পাশাপাশি তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ও বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
জনতা ব্যাংকের সিএসআরে কোনো অনিয়ম হয়নি দাবি করে অর্থমন্ত্রীকে তা তদন্ত করে দেখতেও বলেছেন তিনি।
নিজের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে জনতা ব্যাংকের কোনো কর্মীকে হেনস্তা করা হলে তার বিরুদ্ধে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বারকাত।
গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মুহিতের সঙ্গে বাদানুবাদ চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সোমবার বিদায় নেয়া বারকাতের।
অর্থমন্ত্রীর তদবির না শোনায় জনতা ব্যাংকের সিএসআর বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ বারকাত তুললে তার প্রতিক্রিয়ায় মুহিত বলেন, মেয়াদ না বাড়ায় ‘মনের দুঃখে’ এসব কথা বলছেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
বুধবার জনতা ব্যাংকের ‘সামাজিক দায়বদ্ধতার পাঁচ বছর-২০০৯ থেকে ২০০১৩’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনার জবাবে নিজের বক্তব্য নিয়ে আসেন বারকাত।
জাতীয় প্রেসক্লাবের এই অনুষ্ঠানে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. মঈনউদ্দিন, সঙ্গীতা আহমেদ ও এসএম কামরুল ইসলামও ছিলেন।
তাদের পাশে রেখে অনুষ্ঠানের শুরুতেই বারকাত বলেন, “এটা যেহেতু একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। এখানে প্রশ্ন করার সুযোগ বিশেষ নেই। এরপরও আপনাদের কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে আগেই বলতে পারেন।”
এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন শুনে একে একে তার উত্তর দিতে গিয়ে মুহিতের ওপর বাক আক্রমণ চালান বারকাত।
বারকাত দাবি করেন, আওয়ামী লীগ কিংবা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি মুহিতের কোনো আনুগত্য নেই, বরং তিনি বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফের নব্য উদারতাবাদ উন্নয়ন দর্শনে বিশ্বাসী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুহিতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারে মুহিতের যোগ দেওয়ার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
এরপর সাত বছর আগে জরুরি অবস্থার সময়ও মুহিতের ভূমিকা বিতর্কিত ছিল দাবি করে বারকাত বলেন, “ওয়ান ইলেভেনের সময় আমরা যথন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছি, সাফাই সাক্ষী দিচ্ছি, তিনি তখন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন করেছেন।”
অর্থমন্ত্রীর মুখে বহুবার আসা ‘রাবিশ’ শব্দটি ধরে তিনি বলেন, “মুহিত সাহেব মানুষকে হেয় করেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য দেওয়া, মর্যাদা দেওয়া শেখেননি। সেজন্য কথায় কথায় রাবিশ বা সমজাতীয় শব্দ ব্যবহার করেন।
“তিনি এলিটিস্ট আঞ্চলিকতায় পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি এলাকার লোকজনের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদিতে তদবির করেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে না হলেও তার সম্পৃক্তরা এসব করছে। কিন্তু এটা করতে পারেন না, কারণ অর্থমন্ত্রী একটি প্রতিষ্ঠান।”
মুহিতের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে বারকাত বলেন, “অর্থমন্ত্রী তার ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, ভাইপো, ভাইজি, ভাগ্নি, তাদের জামাইকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। অযোগ্য হলেও তাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে সংবিধান লংঘিত হয়েছে।
“আমি মনে করি, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। অনায্য, অন্যায় তদবির করেন। তিনি আমার কাছে একটি টেলিভিশন চ্যানেল আমদানির জন্য ব্যাংক গ্যারান্টির তদবির করেছিলেন। আমি বলেছিলাম এই গ্যারান্টি দিলে তা ফান্ডেড হয়ে যাবে। হলও তাই, এখন এর দায়িত্ব কে নেবে?”
“অর্থমন্ত্রী বুদ্ধিভিত্তিক জালিয়াতি করেন, অবলীলায় মিথ্যা বলেন, মিথ্যা বলতে পারদর্শী,” বলেন এই শিক্ষক।
বারকাত ২০০৯ সাল থেকে দুই মেয়াদে গত ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
বারকাতের মেয়াদ আর না বাড়ানোর কথা জানিয়ে মুহিত বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের সমর্থক লোকজন এবং তাদের মধ্যে ইনটেলেকচুয়াল জায়ান্ট অনেকেই আছেন। তাদের আমাদের দেখাশোনা করতে হয়। একজন চেয়ারম্যান অব দ্য বোর্ড অনন্তকাল থাকবেন-এ রকম আশা করার কোনো কারণ নেই।”
এর জবাবে বারকাত বলেন, “অর্থমন্ত্রী আপনি আমাকে চেয়ারম্যান করেননি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জনতা ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “উনার (মুহিত) কথার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। উনি আমার দুঃখ, সুখের কী জানেন? উনার সুখ হতে পারে, আনন্দ হতে পারে। কারণ উনি প্রতিহিংসাপরায়ণ।
“উনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের জায়ান্ট ইকোনোমিস্ট আছে। উনি নিজে ইকোনোমিস্ট নন, তাহলে জায়ান্ট ইকোনোমিস্ট কাকে বলে, বুঝবেন কী করে? উনি নব্য উদারতাবাদের অর্থশাস্ত্রের দালালদের খুঁজছেন, যারা উনার ব্যক্তিগত আস্থাভাজন হবেন।”
এর বিপরীতে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক দর্শনে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন অর্থনীতি সমিতির সভাপতি।
জনতা ব্যাংকের সিআরএস বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এই ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থের অবক্ষয় হয়েছে। এছাড়া সিএসআর যেভাবে করা হয়েছে তা মানসম্পন্ন হয়নি।
জনতা ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রম জনগণের সামনে তুলে ধরতে ‘সামাজিক দায়বদ্ধতার পাঁচ বছর-২০০৯ থেকে ২০০১৩’ বইটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানান বারকাত।
“অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জনতা ব্যাংক যত্রতত্র সিএসআর করেছে বা কী করেছে তা উনি জানেন না। কিন্তু বছরের শুরুতে আমরা (জনতা ব্যাংক) ব্যাংকের বেতন-ভাতা, সিএসআরসহ কী কী ব্যয় হবে, তার একটি রিপোর্ট উনাকে দিয়ে থাকি। এরপরও উনি এরকম বললে আমি কী বলব?”
“অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকের অবক্ষয় হয়েছে, এজন্য পর্ষদ দায়ী। আমি বলব, প্রথম কথা হল অবক্ষয় হয়েছে কি না? জনতা ব্যাংকের কোনো অবক্ষয় হয় নাই। তিনি (অর্থমন্ত্রী) মিথ্যা বলেছেন। প্রকৃত সত্য জেনে নিয়ে জনতা ব্যাংকের কাছে তার মাফ চাওয়া উচিত।”
বারকাত দাবি করেন, তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর পাঁচ বছর শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত ১১৬ শতাংশ, ঋণ ৯৭ শতাংশ, সম্পদ ১১৯ শতাংশ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমেছে। ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিট মুনাফা হয়েছে ২০১৩ সালে ৯৫৫ কোটি টাকা।
সিএসআর নিয়ে সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, “সিএসআর হচ্ছে মন ও মেধার বিষয়। চেয়ারে বসলে অনেকেরই এই মন বা মেধা কোনো না কোনোটা হারিয়ে যায়।
“আমি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করেছি। আইলা, সিডর, মঙ্গা, চর, হাওর, বাওড় অঞ্চলের প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ ব্যবস্থা চালু করেছি।”
বারকাত বলেন, তার দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরে জনতা ব্যাংকে কোনো অঘটন ঘটে থাকলে তার সব দায়িত্ব তার।
“আমি প্রস্তাব করছি দরকার হলে তদন্ত কমিটি করেন। তবে জনতাসহ সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন। ব্যাংকিং সচিবের নিচে দাবায়ে রাখার চেষ্টা করবেন না।”
“আমার অবর্তমানে জনতা ব্যাংকের কোনো কর্মীকে হেনস্তা করবেন না। যদি তা করেন তবে আমি রাস্তায় নামতে বাধ্য হব,” অর্থমন্ত্রীকে হুঁশিয়ার করেন তিনি।
অর্থনীতির আরো খবর