এফবিসিসিআই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এফবিসিসিআইর সুপারিশের অধিকাংশ রাখা হয়নি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এই সংগঠনের দেওয়া ৪৪৭টি প্রস্তাবের মধ্যে বাজেটে মাত্র ৫৩টি রাখা হয়েছে। ৩৯৪টি সুপারিশই অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এ জন্য ‘লজ্জাবোধ’ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। আগামীতে প্রাক্-বাজেট প্রস্তাবনা দিতে যাবেন কি-না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীদের পেটে ছুরি চালানো হয়েছে।
শনিবার প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য এফবিসিসিআই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মাতলুব আহমাদ। রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনসহ পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। লিখিত বক্তব্যে মাতলুব আহমাদ বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা, জবাবদিহি ও তদারকির মান বাড়ানোর তাগিদ দেন।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘জটিল’ বলে মন্তব্য করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, এমন বাজেট ব্যবসায়ীরা আগে কখনও পাননি। তিনি জানান, বাজেট প্রস্তাব দিতে এনবিআর পরামর্শক কমিটির সংলাপে এফবিসিসিআইকে ডাকা হয়েছিল। সভায় ব্যবসায়ীরা আগামী অর্থবছরের বাজেটে যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার সিংহভাগই রাখা হয়নি। এতে ব্যবসায়ীদের পরিশ্রমই বৃথা গেছে। তাই আগামীতে এনবিআর ডাকলে আর যাবেন কি-না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, চার মাস শ্রমের পর দেওয়া প্রস্তাব থেকে মাত্র ১১ শতাংশ রাখা হয়েছে। এতে ‘লজ্জাবোধ’ করছেন তিনি। বাজেটের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা হাওয়ার ওপরে কোনো প্রস্তাব দেননি। এনবিআর চার মাসে ব্যবসায়ীদের পেটের খবর নিল, পরে পেটেই ছুরি চালাল। এফবিসিসিআইর পক্ষ থেকে বই আকারে প্রস্তাব দেওয়া হলো, অথচ তার কিছুই রাখা হলো না।
মাতলুব আহমাদ বলেন, ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে না পারলে ভ্যাট কোথা থেকে দেবেন। এনবিআর একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। তাহলে কেন এই প্রহসনের সংলাপ করা হয়েছিল? এনবিআরের কর্মকর্তারাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে চান না অভিযোগ করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা রাজস্ব দিতে চান। রাজস্ব কর্মকর্তারাই চান না যে রাজস্ব বাড়ূক। তিনি আরও বলেন, ভ্যাট আইন নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনায় যৌথভাবে সাতটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার একটিও প্রস্তাবিত বাজেটে আসেনি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি আশা করছেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আগে বিষয়টির সুরাহা হবে।
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দশমিক ৮ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স আছে। একইভাবে বাংলাদেশে দশমিক ৫ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া পাউরুটি, কেক ও বিস্কুট এবং প্লাস্টিক ও রাবারের তৈরি হাওয়াই চপ্পল, প্লাস্টিকের পাদুকার ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান।
এফবিসিসিআইর লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়, সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টাকা টার্নওভারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দোকানের ক্ষেত্রে বাজেটে প্যাকেজ ভ্যাট প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই ৮০ লাখ টাকার ওপরে টার্নওভার থাকে। এ জন্য এসব দোকান প্যাকেজ ভ্যাটের বাইরে থাকবে। এ কারণে প্যাকেজ ভ্যাট ঘোষণাটি অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করছে এফবিসিসিআই।
প্যাকেজ ভ্যাটের বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ী বা দোকান পর্যায়ে টার্নওভারের পরিমাণের ওপর দশমিক ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকার জন্য ২৮ হাজার টাকা, বাইরে এলাকাভিত্তিক ২০ হাজার, ১৪ হাজার ও সাত হাজার টাকা করে প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে কেবল উৎপাদন পর্যায়ে ৩৬ লাখ থেকে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ওপর ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর আরোপের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত বাজেটে ৮০ লাখ টাকার ওপরে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর রয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে রফতানির ওপর উৎসে কর কর্তনের হার দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ৫ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। রফতানিসহ বিভিন্ন উৎসে করের প্রস্তাব বাতিল করে আগের অবস্থায় আনার দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া সংগঠনটি পোশাক শিল্পের করপোরেট করের হার আরও ১০ শতাংশ কমানোর দাবি করেছে। এ সুবিধা না দেওয়া হলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে না। তা ছাড়া আমদানি পর্যায়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি, মৌলিক কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়ের সীমা আবারও তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি জোরদার করতে বিশেষ রেয়াতি শুল্ক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
এফবিসিসিআইর প্রস্তাবে জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে কৃষিসহ করমুক্ত ও একতরফা দ্বৈতকর চুক্তির আওতায় বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কর অব্যাহতি বাদ দিয়ে প্রাসঙ্গিক কর জিডিপি হিসাব করার কথা বলা হয়। সংশোধিত এনবিআরের রাজস্ব আয়ের ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ওপর ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দাবি জানানো হয়। এফবিসিসিআই মনে করে, রাজস্ব আদায় বেশি হলে উৎপাদনশীল খাতে চাপ বাড়বে ও ব্যবসায়িক খরচ বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ব্যাহত হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ডলার চুরি ও বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন এফবিসিসিআইর সভাপতি। তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় এ সব বিষয় সংসদে তুলে ধরা হয়নি। অন্যদিকে পুঁজি হারানো সরকারি ব্যাংকে পুনঃঅর্থায়নের জন্য জনগণের করের টাকা থেকে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এ সব ব্যাংকের অনিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম আরও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু পরিচালন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সমগ্র বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুলে ধরার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানানোর জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি।