টাকা ছাড়া এয়ারকন্ডিশন!

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি

bc40e314cf2e56619981cabb4d59e117-9

গরমে অতিষ্ঠ মানুষকে একটুখানি শান্তির পরশ দিতে পারে প্লাস্টিকের বাতিল বোতল। ভাবছেন অভাবনীয়? পরিচিত হোন স্রেফ ফেলে দেওয়া বোতল কাজে লাগিয়ে ঘর ঠান্ডা রাখার পরিবেশবান্ধব এক কৌশলের সঙ্গে।
নিভৃত এক গ্রাম। মধ্যদুপুরে রোদের তাপে সবকিছু যেন খাঁ খাঁ করছে। এক মা তাঁর শিশুসন্তানকে বিছানায় ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। টিনের তৈরি সে ঘর বিদ্যুৎবিহীন। তাই ক্রমাগত হাতপাখা নাড়ছেন। কিন্তু কিছুতেই যেন স্বস্তি মিলছে না। একে তো টিনের ঘর, তার ওপর জানালা দিয়ে ঢুকছে উত্তপ্ত বাতাস। কী করবেন মা?

শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র? সে তো দরিদ্র মানুষের সাধ্যের বহু দূরে। গরমে অতিষ্ঠ মানুষকে একটুখানি শান্তির পরশ দিতে পারে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল। ভাবছেন অভাবনীয়? স্রেফ ফেলে দেওয়া বোতলকে কাজে লাগিয়েই ঘর ঠান্ডা রাখার দুর্দান্ত এক কৌশল উদ্ভাবন করেছেন আশীষ পাল। সেই উদ্ভাবন বাস্তবে রূপায়ণ আর তার সুফল গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে আশীষের সঙ্গে এককাট্টা হয়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে। সঙ্গে আছে গ্রামীণ-ইন্টেল। বাতাস শীতল করার এই যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইকো-কুলার’ বা পরিবেশবান্ধব কুলার। গ্রামের সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎবিহীন এই কুলার ব্যবহার করে ঘরের তাপ কমাতে পারেন স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সে​িন্টগ্রেড পর্যন্ত। পরিবেশবান্ধব এই কুলার তৈরির উপকরণও মেলে হাতের নাগালে। এরই মধ্যে দেশের বাইরেও এই উদ্ভাবন সাড়া ফেলেছে। এই নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।

অনুপ্রেরণার নাম হাওয়া মহল

বিজ্ঞান অন্তঃপ্রাণ মানুষ আশীষ পাল। পেশায় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রের ক্রিয়েটিভ সুপারভাইজার। এই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মাথাতেই প্রথম বাসা বাঁধে ‘ইকো-কুলার’ তৈরির আইডিয়া! কীভাবে এল এই উদ্ভাবনী চিন্তা? জানতে যোগাযোগ করেছিলাম উদ্ভাবক আশীষ পালের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন ‘কয়েক বছর আগে ভারতের রাজস্থানের এক হাওয়া মহলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সে মহলের একটি ব্যাপার আমাকে খুব ভাবিয়েছে, মহলের ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাস ঢুকে কীভাবে ভেতরটা ঠান্ডা হয়। সে সময় কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। তবে তখন থেকেই বিষয়টি মাথায় ঘুরতে থাকে।’

প্রতিদিনের ব্যস্ততায় দিন কাটে। বিষয়টি নিয়ে আর বেশি দূর এগোনো হয় না আশীষ পালের। তবে একদিনের এক ছোট ঘটনা এনে দেয় আলোর সন্ধান। কী সে ঘটনা? ‘একদিন বাসায় আমার মেয়েকে পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন এক শিক্ষক। চাপের ফলে গ্যাস কীভাবে শীতল হয় এই বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলছিলেন। বিষয়টি আমাকে দারুণ উৎসাহী করে তোলে। এত দিন ধরে যে বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম তার অনেকটা উত্তর আমি পেয়ে যাই।’ বলছিলেন আশীষ।

আশীষ তাঁর ভাবনার কথা বলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের সঙ্গে। এ জন্য অফিসেই বানানো হয় টিনের তৈরি ঘরের কাঠামো। তারপর পরীক্ষা চালানো হলো কতটা কার্যকর তা বোঝার জন্য। এই উদ্ভাবনীকাজে আগ্রহ নিয়ে যুক্ত হোন আশীষ পালের সহকর্মী ও গ্রের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ জাইয়ানুল হক। তারপর তাঁরা রাজধানীর নিকেতন হাউজিং সোসাইটির একটি বাসার ছাদেও উদ্ভাবনের নানা দিক নিয়ে কাজ করলেন। বেশ সাফল্য পেলেন তাঁরা। সে সাফল্যের সূত্র ধরেই তাঁরা ‘ইকো-কুলার’ প্রকল্পের পথে এগোলেন। ‘ইকো-কুলার’ প্রকল্পের বাকি গল্পটা শুনতেই আমরা হাজির হয়েছিলাম ঢাকায় এই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র উদ্ভাবন-প্রক্রিয়ার সূতিকাগার গ্রের কার্যালয়ে।

‘আমাদের দেশ বন্যাপ্রবণ, যে কারণে গ্রামের অধিকাংশ ঘর তৈরিতে মাটির বদলে টিন ব্যবহার করা হয়। গ্রামের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এই টিনের ঘরেই বসবাস করেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই টিনের ঘরগুলো গ্রীষ্মকালে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির পুরুষ মানুষ ঘরের বাইরে গাছের তলায় বসতে পারে। কিন্তু নারীদের গরম সহ্য করে ঘরেই থাকতে হয়। এই বিষয়গুলো চিন্তা করেই আশীষ পালসহ আমরা দলগতভাবে সহজে কুলার তৈরি করার কাজ শুরু করি।’ তাদের দলীয় ভাবনার শুরুর কথা বলছিলেন মোহাম্মদ জাইয়ানুল হক।

গ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাউসুল আলম শাওন সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আশীষের ভাবনাটা খুব চমকপ্রদ মনে হয়েছে আমার কাছে। কী সহজ একটি বিষয় অথচ কতটা বিজ্ঞাননির্ভর।’ কিন্তু গ্রে তো একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা মূলত? তারা কীভাবে যুক্ত হলো এ ধরনের উদ্ভাবনের সঙ্গে? তার ব্যাখ্যা শাওন দিলেন এভাবে।

 ‘নিয়মিত কাজের বাইরে প্রতিবছরই নতুন কোনো উদ্ভাবন নিয়ে মাঠে নামি আমরা। এই ইকো-কুলারকে উদ্ভাবন হিসেবে মানোন্নয়নের কাজ শুরু করা হয় গত বছরের শুরুর দিকে। এর কোনো প্যাটেন্ট আমরা করিনি। আমরা চেয়েছি সাধারণ মানুষ যাতে সহজে এটি বানিয়ে নিতে পারে।’


যেভাবে
কাজ করে ইকো-কুলার
আপনি চাইলে ইকো-কুলারের শীতলীকরণ কাজটি নিজেই প্রমাণ করতে পারেন। কীভাবে করবেন? মুখের সামনে হাত মেলে ধরুন, তারপর মুখ হা করে জোরে শ্বাস ছাড়ুন। গরম বাতাসের অনুভূতি পাবেন হাতে। এবার একই কায়দায় মুখের সামনে হাত রাখুন, তবে হা না করে শ্বাস ছাড়ুন ঠোঁট সরু করে। এবার কিন্তু বাতাসের অনুভূতি পাবেন আগের চেয়ে ঠান্ডা। অর্থাৎ মুখ হা করে শ্বাস ছাড়ার পর বাতাসে যতটা গরম অনুভূত হয়েছে তার চেয়ে ঢের কম গরম বোধ হবে ঠোঁট সরু করে শ্বাস ছাড়লে। ঠিক এই সহজ বিষয়টিই ব্যবহার করা হয়েছে ইকো-কুলার তৈরিতে। এর ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় যদি তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি। তাহলে ইকো-কুলারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঘরে যে বাতাস ঘরের ভেতরে ঢুকবে তার তাপমাত্রা নেমে আসতে পারে ২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। উদ্ভাবক আশীষ পাল বলছিলেন, ‘বিদ্যুৎ–চালিত শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মতো এটি দ্রুত বা সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমাবে না। তবে ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাও যদি আমরা কমাতে পারি গরমে অতিষ্ঠ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য সেটিও কম কথা নয়।’

মানুষের কাছে
এই প্রযুক্তি গ্রামে গ্রামে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। আশীষ পালসহ ১৫ জনের একটি দল নীলফামারী জেলার একটি গ্রামে যায়। এবার গ্রের সঙ্গে যুক্ত হয় গ্রামীণ-ইন্টেল। মোহাম্মদ জাইয়ানুল হক বলছিলেন, ‘আমরা এই উদ্ভাবনের সুবিধা মানুষের কাছ পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাই। তবে প্রথম প্রস্তাবেই সাড়া মেলে গ্রামীণ-ইন্টেলের কাছ থেকে। তারা নিজেরাও এমন প্রকল্পই খোঁজ করছিল। এককথায়, গ্রামীণ-ইন্টেল লুফে নিয়েছিল প্রকল্পটি।’ তারপর দুই প্রতিষ্ঠান মিলে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় পদ্মাপাড়ের একটি গ্রাম বেছে নেয়। এখন সেই গ্রামের বিভিন্ন ঘরে চলছে যন্ত্রটি বসানোর কাজ। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার বড়গাছা গ্রামের পীযূষ কুমার রায় বলেন, ‘আমি কয়েক মাস ধরে ইকো-কুলার ব্যবহার করছি। বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘর বেশ ঠান্ডা রাখে এই যন্ত্র।’

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে

ফরাসি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘ফ্রান্স ২৪’। এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ফরাসি, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় প্রচারিত তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল। টেলিভিশন সম্প্রচারের পাশাপাশি তিন ভাষাতেই রয়েছে তাদের ওয়েব পোর্টাল। সেখানে বিশ্বের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশের ওয়েবসাইট ‘অবজার্ভার’। ২ জুন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়েছে প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব কুলার উদ্ভাবনের খবর। শুধু ফরাসি এই সংবাদমাধ্যমেই নয়, ইকো-কুলার বানানোর পদ্ধতি নিয়ে তৈরি করা ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউব আর ইকো-কুলারের ওয়েবসাইটের (http://www. eco-cooler. com/) মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এ পর্যন্ত এই ভিডিওটি দেখা হয়েছে আট লাখের বেশিবার।

গাউসুল আলম শাওন বলছিলেন, ‘এরই মধ্যে কেনিয়াসহ কয়েকটি দেশ এই প্রযুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। এই প্রযুক্তির আসল মজাটা হচ্ছে এটি স্রেফ একবার দেখিয়ে দিলেই যে কারও পক্ষে রপ্ত করা সম্ভব। আমরা প্রযুক্তিটা দেখিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা চাই মানুষ নিজেরাই এর ব্যবহার শিখে নিয়ে এর সুফল নিক।’

 

আপনিও বানাতে পারেন ইকো-কুলার
১. প্রমাণ আকারের সরু মুখের প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করুন। ব্যবহৃত পরিশোধিত পানির বোতল, কোমল পানীয়ের বোতল এ জন্য সবচেয়ে ভালো। ২. ইকো-কুলার স্থাপনের জন্য ঘরের এমন জানালা নির্বাচন করুন যেখান দিয়ে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশ করে। এবার পুরো জানালার মাপ নিন। ৩. জানালার মাপ অনুয়ায়ী একটি বোর্ড সংগ্রহ করুন। এই বোর্ডেই বাসানো হবে বোতলগুলো। ৪. সংগ্রহ করা বোতলের ছিপি খুলুন। তারপর মুখের আকার অনুযায়ী মাপ নিয়ে বোর্ডে বৃত্তকারভাবে কাটুন। ছিপি ছাড়া বোতলের মুখ এই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে। ৫. এবার ছিপির মাথা সমান করে কাটুন। ৬. বোতলের মাঝ বরাবর কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলুন। প্রতিটি বোতলের মুখ বোর্ডে ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে। তারপর মাথা কাটা ছিপি দিয়ে আটকে রাখুন বোতলটি। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল আপনার ইকো-কুলার। বোর্ডটি জানালায় স্থাপনের সময় বোতলের মুখ যেদিকে রয়েছে সে অংশ ভেতরের দিকে রাখুন। ইকো-কুলার তৈরির একটি ভিডিও দেখুন প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে (www.prothom-alo.com ) ইকো-কুলার তৈরির ভিডিও সরাসরি দেখুন এই ঠিকানায়: https://goo.gl/KPn725

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *