মোহাম্মদ আলী। তিনি চেয়েছিলেন শুধু এ নামেই তাকে ডাকা হোক। তার ভাষায়, ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লের জীবন ছিল দাসের। সে জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি হন মোহাম্মদ আলী। দ্য গ্রেটেস্ট ফরএভার। ৬১ ম্যাচে ৫৬ জয়। তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বক্সিংয়ের রিংয়ে তার মতো কেউ আজও আসেননি। কোনোদিন আসবেনও না। গত শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ ছিলেন তিনি। কারও কারও মতে তিনি, সর্বকালের সেরা। শুধু ক্রীড়াবিদ কেন? মানুষ মোহাম্মদ আলী কি তার চেয়েও বড় ছিলেন না? কালো মানুষদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি সব সময় ছিলেন সামনের কাতারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি পান ৫ বছরের সাজা। তবুও অনড় থাকেন মোহাম্মদ আলী।
১৯৭৮ সালে বালাদেশে এসেছিলেন এ মহানায়ক। বস্তুত তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক দূত। বক্সিং রিংয়ে অপরাজিত মোহাম্মদ আলী হেরে গেলেন জীবনযুদ্ধে। কোটি কোটি ক্রীড়াপ্রেমীকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন পরপারে। শুক্রবার রাতের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অরিজোনা রাজ্যের ফিনিক্স এলাকার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি বক্সার (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বেশ কিছুদিন ধরে এখানেই তার শেষ চিকিৎসা চলছিল। সর্বশেষ তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে বৃহস্পতিবার এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী লোনি ও মেয়েরা আলীর পাশে ছিলেন। মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বিশ্বের অনেক শক্তিশালী বক্সারকে কাবু করা মোহাম্মদ আলী সেই ১৯৮৪ সাল থেকে লড়ছিলেন দুরারোগ্য ব্যাধি পারকিনসনে। তার মাথাসহ সমস্ত শরীর সবসময় কাঁপতো। আর শেষদিকে তার স্মৃতি শক্তিও লোপ পেয়ে গিযেছিল। বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আলী কেবল রিংয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, তিনি চির স্মরণীয় ও সম্মানীয় তার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর মানবতাবাদী মনোভাবের জন্য। মেধা, শৈলী, চাতুর্য, সাহস, দুরন্ত গতি তাকে প্রতিষ্ঠিত করে অনন্য এক ক্রীড়াবিদ হিসেবে।
মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেও তার বেশ আগে থেকেই বিশ্বের সব কালো যুবকদের আদর্শ পুরুষে পরিণত হন মোহাম্মদ আলী। কালোদের প্রতি মার্কিন শ্বেতাঙ্গদের অবহেলাই আলীকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তিনি নিজেই নিজেকে দ্য গ্রেটেস্ট উপাধি দিয়েছেন। তিনবারের হেভিওয়েট শিরোপাজয়ী আলী বলেন, আমি কেবল গ্রেটেস্ট নই, আমি ডাবল গ্রেটেস্ট। আমার মতো শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির বিনয়ী হওয়া কঠিনই। তার আগে কেউ এ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে বক্সিং রিং থেকে অবসরে যান যান তিনি। প্রথম পেশাদার জীবনে ১৩১ লড়াইয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে হারেন তিনি। ছন্দে আর নৃত্যে যেভাবে তিনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেন তা মুষ্ঠিযুদ্ধকে একাটা বিশেষ শিল্পে পরিণত করেছিলেন তিনি। আলী যখন দুলে দুলে প্রতিপক্ষকে আঘাত করতেন তখন তিনি প্রজাপতির মতো উড়তেন বলে মনে হতো। ফুটবলে পেলে না ম্যরাডোনা, ক্রিকেটে শচীন না লারা, ব্র্যাডম্যান না সোবার্স, টেনিসে ফেদেরার না সাম্প্রাস সেরা তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে দীর্ঘ। কিন্তু বক্সিংয়ে আলী ছিলেন অতুলনীয়। শরীরে কোনো বাড়তি মেদ ছিল না। হালকা পাতলা গড়ন ছিল। দেখতে ছিলেন খুবই সাদাসাটা। কিন্তু মুষ্ঠিতে ছিল অসীম শক্তি। আর মনের জোরটা ছিল তার আরও অনেকগুণ বেশি।
ষাটের দশকে তার সেরা সময়ে মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে তিন বছর নিষিদ্ধ থাকেন বক্সিং থেকে। ২৫ থেকে ২৮ বছর বয়সে তিনি যদি লড়তে পারতেন তবে তার সাফল্য আরও বিস্তৃত হতো। তিনি যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমন ছিলেন জনদরদী, মানবহিতৈষী। এ কারণে ওই সময়ে তিনি দেশে অনেকের কাছে অপ্রিয় হলেও বিশ্বব্যাপী তার ভক্ত সংখ্যা বেড়ে যায়। তার মধ্যে দার্শনিক মনোভাব যেমন ছিল তেমন রসবোধও ছিল প্রবল। তার অনেক কথাই এখন অমৃতবাণীর মতো হয়ে আছে। মোহাম্মদ আলী সবসময়ই অনুপ্রাণিত ছিলেন তার নিজের আদর্শের চেতনায়। ১৯৪২ সালের ১৭ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। ১২ বছর বয়সেই তার বক্সিং রিংয়ে পা রাখা। তার সাইকেল চুরি যাওয়ার ঘটনায় আলী জড়িয়ে পড়েন বক্সিংয়ে। ছোটভাই রহমান আলীও পরবর্তীতে বক্সিং রিংয়ে আসেন। যদিও তিনি সে রকম আলো ছড়াতে পারেননি অথবা আলীর আলোয় হারিয়ে যান। রহমান জানান, আলী শৈশব থেকেই বেশ হাসি খুশি ছিল। বক্সিং শেখার শুরু থেকেই বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। লুইসেভিলেতে স্থানীয় শিশু হাসপাতালের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য তার প্রথম পেশাদার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ। ১৯৬০ সালের ২৯শে অক্টোবর ১৮ বছর ২৮৬ দিনে মোহাম্মদ আলীর বক্সিং রিংয়ে অভিষেক হয়, প্রতিপক্ষ ছিল টানি হানসেকার। তারপর ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ১৯টি ম্যাচ খেলে সবগুলোতেই জেতেন। এর মধ্যে ১৫টি জয় ছিল ‘নক আউটে’। সে সময় আলী জিম রবিনসন, হেনরি কুপার, জর্জ লোগান, আলন্সো জনসন ও জনি ফ্লি ম্যানের মতো বক্সারদের হারান। ১৯৬২ সালে হারান আর্চি মুরকেও। ১৯৬৩ সালে আলী ও ডাগ জোন্সের ম্যাচটি ছিল ‘ফাইট অব দ্য ইয়ার’। ম্যাচটি হয়েছিল নিউ ইয়র্কের ‘ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে’। এরপর ১৯৬৩ সালে প্রথম দেশের বাইরে যান। সেবার লন্ডনে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন স্থানীয় বক্সার হেনরি কুপার। ১৯৬৪ সালে প্রথম হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন সনি লিস্টনকে হারিয়ে। সপ্তম রাউন্ডে তিনি সনিকে পরাস্ত করেন। ১৯৭৪ সালে জায়ারের রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গলখ্যাত লড়াইয়ে জর্জ ফোরম্যানকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে আলী তার তৃতীয় হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন লিও স্পিংসকে হারিয়ে।
১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক জয়ী খেলোয়াড় হওয়ার পরও রোমের একটি রেস্টুরেন্টে তাঁকে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ‘অপরাধ’ তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ! রাগে, দুঃখে, অপমানে আলী অলিম্পিক মেডেলটি টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেন। ১৯৬১ সালে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মালেক এল শাহবাজের (ম্যালকম এক্স) অনুপ্রেরণায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর থেকে পরিচিত হন ‘মোহাম্মদ আলী’ নামে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তার হেভিওয়েট শিরোপা কেড়ে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। যদিও তাকে শেষ পর্যন্ত কারাগারে যেতে হয়নি। ১৯৭১ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে। তবে সাড়ে তিন বছর তিনি নিষিদ্ধ থাকেন রিং থেকে। খেলার জগৎ থেকে অবসর নেয়ার পরও নানা পুরস্কার আর উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। আলীর এক মেয়ে লায়লা আলীও বক্সিং জগতে সুনাম কুড়ান। তিনি লাইট মিডলওয়েট শিরোপাও জেতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি চার বিয়ে করেন। এদের ঘরে সাত মেয়ে ও দুই ছেলের জনক তিনি।
১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলনের গর্বের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ২০০৫ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদকে ভূষিত করেন। নির্যাতিত- নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৮-এ আলী বাংলাদেশও সফর করেন। ওই সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেয়া হয়। ঢাকায় বাংলাদেশের বক্সিং স্টেডিয়ামটিও মোহাম্মদ আলীর নামে প্রতিষ্ঠিত।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম