★ডা.মাজহারুল আলম :সেদিনের ভাওয়াল,আজকের গাজীপুর।ভাওয়ালের স্বভাবকবি ভাগ্যাহত গোবিন্দ চন্দ্র দাসের কত বেদনার কথা যে দেশবাসীর অজানা!- এমন কি ভাওয়ালের সাহিত্যরসিক অধুনা সমজদারগণও তেমন একটা খবর রাখেন বলে মনে হয় না।
কোন্ স্পর্শকাতর হৃদয়টা জন্মভূমি ভাওয়ালের জন্য কেমন করে, কেনই বা হাহাকার করে উঠেছিল? ভাওয়াল রাজার ঐরাবতের পদতলে পিষ্ট হয়ে শুধুই কি সেদিন অভাগা কবি ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিলেন? তাঁর আবক্ষলালিত ভাওয়ালকে ত্যাগ করার যন্ত্রনা যে কবির অন্তরে তীব্র বেদনার মহীরুহ তৈরি করেছিলঃ………
“যাই প্রিয় জন্মভূমি জননী আমার
ভুলেছ কি গতকথা আছে কি মা মনে?
সহিয়াছি কতশত প্রেত অত্যাচার
জননী তোমার তরে অকাতর মনে।”
বয়ে চলেছে বহমান ভরা চিলাই, তারই গাত্রে কত বড় বেলাই বিল! বিশাল জলরাশির এতো উপচে পড়া অগণিত ঢেউ! পেরেছে কি বিদগ্ধ অচেনা কবির অজানা বুকের ভার লাগব করতে………
“ইচ্ছে করে ওই বুকে বুক রাখি
অমনি লুকিয়ে থাকি,
ভুলে যাই এ সংসার জ্বালা যন্ত্রনার!
শতকষ্ট শতদুখ, এ অন্তর দগ্ধবুক
নিভাই প্রাণের গুপ্ত জ্বলন্ত অঙ্গার!
পুণ্যেরর পবিত্র তীর্থ বিল বরষার।।”
আবার কী ভেবে ক্ষণিকের জন্য বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। “ভাওয়াল আমার অস্থিমজ্জা, ভাওয়াল আমার প্রাণ” নিয়ে কতক্ষণই বা চুপ করে থাকা যায়?
“মরতে হবে মরব তাহে ক্ষতি কিছু নাই,
পচা মরণ দিওনা আর তাজা মরণ চাই।
সিংহ মরে ব্যঘ্র মরে মহিষ মরে বনে,
বন্য পশুর ধন্য জীবন আত্মসমর্পনে।
মানুষ আমি মরব নাকি অন্ধ কারাগারে,
কাপুরুষ পাতকীর মত চরণ প্রহারে?”
তিলে তিলে জীবন গ্রাসকারী দারিদ্রের মাঝেও
তুষের আগুনের মত জ্বলেছে তাঁর প্রতিবাদের ভাষাঃ—-
“অঙ্গারকের শালার শালা তস্য শালা যারা,
রাজার বাড়ীর কর্মচারী এখন সবে তারা–।”
ভেতরের কোন কথাই যেন কবি গোপন করেন নি কোনদিন।ভালবাসার কথা যখন হৃদয়ে এসেছে, তার মধ্যেও যেন নেই কোন ফাঁকির খোলস…….
“ আমি তাকে ভালবাসি অস্থিমজ্জা সহ”
— কে এমন আছে জগতে? বাস্তবতাকে নির্ভেজাল সরলতা দিয়ে সততাকে প্রকাশে সাহসী কবি তো একজনই—তিনি যে গোবিন্দ চন্দ্র দাস!
জীবনের অন্তিম লগ্নে স্বভাবকবির মানসকুঞ্জে ভেসেে ওঠে জীবন মরণের মাঝে নদী পারাপারে ভাবনা। পারঘাটাতে তাঁর এক পা তখন নায়ে চলে গেছে, দিনের রবি সাঁজের বেলায় ডুবে যাচ্ছেঃ—–
“দিন ফুরিয়ে যায়রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়,
মাঝের রবি ডুবলো সাঁজে
দিনটা গেল বৃথা কাজে
এক পা আছে পারে আমার,এক পা দিছি নায়!
দিন ফুরিয়ে যায়রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়।।
সম্ভবতঃ ভাওয়ালের গোবিন্দ চন্দ্র দাসই বাংলার একমাত্র খ্যাতিমান কবি, যিনি বাল্যকালে-কৈশোরে পথের ধারে,যৌবনে কর্মের অস্থিরতায়,প্রৌঢ়ে চরম দারিদ্রের কষাঘাতে, মরণে সমাজের নিদারুণ অবহেলায় এবং এখনও সাহিত্য অঙ্গনের উদাস বাতায়নে মর্মান্তিকভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত।।
(সংক্ষিপ্ত)