গোলাম মাওলা রনি: নিবন্ধের শুরুতেই সফলতা ও সার্থকতা শব্দ দু’টির ব্যাখ্যা দেয়া অত্যাবশ্যক। সফলতা একটি সর্বজনীন শব্দ। যে কেউ যেকোনো কাজে সফল হতে পারেন। একজন চোর, পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীও আপন আপন কর্মে সফলতা অর্জন করতে পারে। সফলতার সাথে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও পারিপার্শ্বিক সুযোগ-সুবিধার গভীর যোগাযোগ রয়েছে। ফলে দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা একজন মানুষ যেমন সফল হতে পারেন, তেমনি হঠাৎ কোনো সুযোগ, পদ-পদবি বা কারো দয়া-দাক্ষিণ্য ও করুণার দানে যে কেউ রাতারাতি সফল বলে বিবেচিত হতে পারেন। ব্রিটিশ জমানায় মুচিরাম গুড়ের রায় বাহাদুর খেতাবপ্রাপ্তির ঘটনার ব্যঙ্গরস সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামবাংলার অভাবী কৃষক মুচিরাম গুড় যেমন বিলেতে সাহেবের অপরিণত বাংলা অক্ষরজ্ঞানের বদৌলতে হঠাৎ করে সরকার কর্তৃক ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি লাভ করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন, তদ্রুপ আধুনিক সমাজে কথিত সফল মানুষের মূল কীর্তিকলাপ যে ঘুষ, দুর্নীতি, চাটুকারিতা, অন্যায়, অপরাধসহ নানা কুকর্ম তা নতুন করে বলার তেমন অবকাশ নেই।সফলতা হলো মানুষের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপ, যার সাথে নীতি ও আদর্শের কোনো সংযোগ থাকে না। এ কারণে উত্তম মানুষেরা কোনোদিন সফলতার পেছনে ছোটেন না- তারা তাদের আপন কর্মের সার্থকতা খোঁজেন। সার্থকতা হলো এমন একটি অনিন্দিত সফলতা, যা লাভ করে মানুষ সমাজে নিজেকে সম্মানিত, মর্যাদাবান এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ লাভ করে। সব সফলতার ইতিহাস লিখিত থাকে না; কিন্তু সব সার্থকতার ইতিহাস চমৎকারভাবে খোদাই করা থাকে- মানুষের অন্তরে এবং লিখিত দলিলে। তাই আজকের আলোচনায় আমরা জীবনে সার্থকতা লাভের মূলমন্ত্র নিয়ে আলোকপাত করব।
জীবনকে সার্থক করার প্রথম মূলমন্ত্রটির নাম পরিশ্রম। কোনো মানুষ কোনোকালে পরিশ্রম ব্যতিরেকে জীবনের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। পরিশ্রমের রয়েছে বাহারি প্রকার, ধরন আর বৈশিষ্ট্য। সাধারণত শরীরের বা দেহের শ্রমকে পরিশ্রম বলা হলেও মানসিক শ্রম ও মেধাশ্রমের গুরুত্বও কম নয়- বরং ক্ষেত্রবিশেষে অনেক বেশি। শ্রমের প্রধানত দু’টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে; যথা উৎপাদনশীল শ্রম এবং অনুৎপাদনশীল শ্রম। এর বাইরে শ্রমকে আরো দুই ভাগে ভাগ করা যায়- যেমন অনুমোদিত শ্রম এবং অননুমোদিত শ্রম। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কথ্য ভাষায় সাধারণত কাজ বলতে আমরা
উৎপাদনশীল এবং অনুমোদিত শ্রমকেই বুঝে থাকি। অন্য দিকে, অনুৎপাদনশীল এবং অননুমোদিত শ্রমকে বলে থাকি অকাজ, কুকাজ ইত্যাদি।
আপনি যদি সার্থক হতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। এমন কাজ করবেন যার অনুমোদন ও স্বীকৃতি রয়েছে। কাজের অবশ্যই বিনিময়মূল্য থাকতে হবে। নিষ্ফল শ্রম অথবা মূল্যহীন শ্রম দ্বারা জীবন চালানো যায় না। একমাত্র কাজই পারে আপনার শরীর, মন ও মস্তিষ্ককে সুখী, সমৃদ্ধ আর সুস্থ রাখতে। কাজের বিনিময় মূল্যই আপনার জীবিকা। কাজের ফলে দেহে যে ক্ষুধা ও ক্লান্তি সৃষ্টি হয় তা আপনার সব শারীরিক এবং মানসিক রোগের মহৌষধ। আপনার দুঃখ, বেদনা, বিনোদন, আহার, নিদ্রা, বিশ্রাম ইত্যাদি সব কিছুর মূলে রয়েছে কাজ অথবা অকাজ। আপনি যতদিন কাজের উপযোগী থাকবেন, ঠিক ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া আপনাকে স্বাগত জানাবে। কাজের সক্ষমতা হারানোর সাথে সাথে আপনি দুনিয়ার সবার কাছে এমন বোঝায় পরিণত হবেন যে, বোঝাটি মাটিচাপা না দেয়া পর্যন্ত দুনিয়াবাসী স্বস্তি ও শান্তি লাভ করবে না। আপনি যদি সব মানসিক যন্ত্রণা, বুকভরা বেদনা এবং অশ্রুভরা চোখের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন তখন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করবেন, ওই সময়গুলোয় আপনার কোনো কাজ ছিল নাÑ অথবা কাজ ছিল কিন্তু আপনি সে কাজ ফেলে বেদনার স্বাদ পাওয়ার জন্য নিজের বুক, মস্তিষ্ক এবং চোখ দুটোকে উৎসর্গ করেছিলেন। আপনি সেই কাজ, যা ছিল মূলত অকাজ, তা করেছিলেন আবেগতাড়িত হয়ে অথবা পূর্বাপর লাভক্ষতির চিন্তাভাবনা না করে অথবা নিতান্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা সামাজিক লজ্জাশরমের কারণে। অর্থাৎ আপনি যদি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যন্ত্রণা অনুভব না করেন এবং চোখের পানি না ফেলেন তবে লোকজন কী মনে করবে, এ থেকেও আপনি বেদনার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেন এবং নিজের অজান্তে নিজেকে সেই রাজ্যের বাসিন্দা বানিয়ে ফেলতে পারেন। বিখ্যাত লেখক ডেল কার্নেগির বইয়ে চমৎকার একটি উদাহরণ রয়েছে। এক ব্যক্তি একমাত্র
পুত্রসন্তানের মৃত্যুতে দারুণভাবে বেদনাহত হয়ে পড়লেন। পৃথিবী তার কাছে নিরর্থক ও বিষাদময় একটি উপাখ্যানে পরিণত হলো। তিনি সারাক্ষণ বিলাপ করতে করতে নিজেকে একেবারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন। তিনি এমনভাবে অনবরত কান্নাকাটি করতে থাকলেন, যা তার বেদনা, দুঃখ, কষ্ট, যাতনা এবং পৃথিবী সম্পর্কে আশাহত মনোভাবকে দিনকে দিন বাড়িয়ে দিতে থাকে। তিনি যখন একেবারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেন তখন তার জীবিত ছোট এবং একমাত্র মেয়েটি তার কাছে এসে অদ্ভুত এক বায়না ধরল। মেয়েটি তার বাবাকে অনুরোধ করল কাঠ দিয়ে ছোট্ট একটি খেলনা নৌকা তৈরি করে দেয়ার জন্য। লোকটি বিলাপ করতে করতে মেয়েটির আবদার পূরণে তৎপর হলো এবং এক সময় সে কান্নাকাটি ভুলে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেশ কয়েক দিন অনবরত কাজ করে সে নৌকাটি তৈরি করল এবং মেয়ের হাতে উপহারটি তুলে দিতে গিয়ে গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মতো হাসল। লোকটি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল যে, তার বেদনা দূর হয়ে গেছে এবং বিগত দিনগুলোয় তার বেদনার জন্য সে কোনো কাজ না করাকেই দায়ী করল। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কিভাবে কাজ করবেন এবং কোন পদ্ধতিতে কাজটি শুরু করবেন? এ ব্যাপারে আপনার আত্মোপলব্ধি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের শরীরটি হতে পারে চমৎকার ও উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ। যদি নিজের শরীরের দিকে খুব ভালো করে লক্ষ করেন, তবে দেখবেন- আপনার শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করা হয়েছে কেবল সামনে এগোনোর জন্য। প্রয়োজনে আপনি পেছনে যেতে পারেন বটে- তবে সামনে এগোনো যতটা সহজ ও সাবলীল তার চেয়ে পেছনে যাওয়া
তুলনামূলকভাবে কঠিন, অস্বস্তিকর এবং ধীরগতির। আপনার হাত দুটো, পা দু’খানা যত সহজে সামনের দিকে প্রসারিত বা অগ্রসর হওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারবেন, ঠিক সেভাবে হাত দু’খানাকে পেছনে নিয়ে পিছপা হতে পারবেন কি? আপনার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, আপনার কথা বলার
শক্তি কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যই উপযুক্ত করে বানানো হয়েছে। আপনার পুরো শরীরকে যেভাবে সামনের দিকে নোয়াতে পারবেন, ঠিক সেভাবে পেছনের দিকে বাঁকা করতে পারবেন না। আপনার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, মোহনীয়তা আর কমনীয়তা ফুটে ওঠে শরীরের সামনের অংশকে কেন্দ্র করে। কাজেই এগিয়ে চলাই হলো শরীরের ধর্ম এবং এগিয়ে চলার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা খুঁজতে হবে।
আপনি এমনভাবে কাজ করবেন যেন নিজে এগোতে পারেন এবং আপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে নিতে পারেন। আপনি এমন সঙ্গী পরিহার করুন যারা তাদের নেতিবাচক মনোভাব, কথাবার্তা এবং কাজকর্ম দ্বারা আপনাকে অবদমিত করার চেষ্টা করে অথবা আপনাকে পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা চালায়। অতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে আপনার জীবনের যেসব উপকরণ, অভ্যাস এবং চিন্তাচেতনাকে বোঝা বলে মনে হয় সেগুলোকে ফেলে দিন অথবা ঝেড়ে ফেলুন। যেসব স্মৃতি আপনাকে বারবার পেছনের দিকে নিয়ে যায় সেগুলো ঝেড়ে ফেলুন, ভুলে যান অথবা বাদ দিন। আপনি এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবার আগে নিজের মনকে স্থির করুন। নিজের বিশ্বাস পাকাপোক্ত করারজন্য অভিজ্ঞ ও সফল মানুষজনের সংস্পর্শে যান। তারপর স্বপ্ন দেখতে থাকুন। ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন বন্ধু-বান্ধবের সন্ধান করুন এবং যেকোনো মূল্যে তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক চমৎকার পর্যায়ে উন্নীত করুন। এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবসময়ই আপনার দরকার পড়বে উত্তম একটি বাহনের। আপনার কাজের ধরন অনুযায়ী আপনার বাহনটি হতে পারে পুঁজি, কায়িক শ্রম, দক্ষতা, সাহস, ধৈর্যশক্তি অথবা যন্ত্র বা হাতিয়ার। আপনি এ বাহনটির সাথে হৃদ্যতা গড়ে তুলুন এবং তাকে একান্ত নিজের সাথে মানিয়ে ফেলুন অনেকটা হংস মিথুনের মতো করে।
মনে রাখবেন, কাজ মানেই প্রতিযোগিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধও বটে। যুদ্ধের ময়দানের সব নিয়মকানুনই কর্মক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশেষ করে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, আনুগত্য, একাগ্রতা, সাহস এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছাড়া যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য। যুদ্ধের ময়দানে আপনাকে হয় সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করতে হবে নতুবা হতে হবে সেনাপতি। এ ক্ষেত্রে সৈনিক যদি সেনাপতি হতে যায় অথবা সেনাপতি যদি সৈনিকের মনমানসিকতা ধারণ করে, তার বিপর্যয় ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কর্মক্ষেত্রে আপনাকে আগে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আপনি যদি শ্রমিক, কর্মী, কেরানি অথবা পিয়ন, ড্রাইভার, দারোয়ান ইত্যাদি হয়ে থাকেন তবে কোনো অবস্থায়ই যোগ্যতা অর্জন ব্যতিরেকে আপনার ম্যানেজার, টিম লিডার অথবা মালিকের মতো ভাবসাব দেখাবেন না। অন্য দিকে, আপনি যদি নেতা অথবা উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন, তবে আপনার মনমানসিকতা এবং আচরণ অনেক উন্নতমানের হওয়া আবশ্যক। কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন এবং জীবনে সার্থকতা অর্জনের জন্য ইতিহাসের কিংবদন্তি কাহিনী, উপাখ্যান, চরিত্রগুলো এবং মূল্যবান দলিল দস্তাবেজ অধ্যয়ন করতে পারেন। আপনি বিজ্ঞান, ভূগোল এবং ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমে চিন্তাকে প্রসারিত এবং মস্তিষ্ককে শক্তিশালী করতে পারেন। উদার ও চরিত্রবান হওয়ার জন্য মহৎ শিল্পকর্ম এবং উন্নত চরিত্রের মানবমণ্ডলীর জীবন চরিত্রকে আপনার সঙ্গী করে নিতে পারেন। আপনার পেশাটি যদি খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়, তবে আপনি মহান সৈনিক জেনারেল সান ঝু রচিত ‘আর্ট অব ওয়ার’ পড়তে পারেন, যা তিনি মানবজাতির জন্য রচনা করেছিলেন আড়াই হাজার বছর আগে। বইটি কেবল বিশ্বজয়ী সামরিক নায়ক-মহানায়কদের পাঠ্যসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি- পৃথিবীর তাবৎ করপোরেট হাউজ, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলো ‘আর্ট অব ওয়ার’কে সম্মান করে ‘জীবনযুদ্ধের বাইবেল’রূপে।
সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত