শ্যামল কান্তিকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে স্কুল কমিটি

Slider জাতীয়
shamal_kanti_samakal_212843_213219
পরিচালনা কমিটির সদস্যদের অন্যায় আবদার না রাখায় হেনস্তার শিকার হয়েছেন শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। তাকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে দিতে আগে থেকেই বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছিল। মিথ্যা অজুহাতে ২০ বার শোকজও করা হয়েছিল।

পরিচালনা কমিটির সভাপতি চেয়েছিলেন শ্যামল কান্তিকে সরিয়ে তার বোন পারভীন আক্তারকে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করতে। তিনিসহ কমিটির অন্য সদস্যরা সুযোগ খুঁজছিলেন তাকে কীভাবে ফাঁসানো যায়। সর্বশেষ ছাত্র মারধরের পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কথা তুলে সভার নামে তারাই স্থানীয়দের একত্র করেন। পরে মারধর ও স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের নির্দেশে ওই শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। সর্বশেষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এদিকে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে এমপি সেলিম ওসমান ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলাম। নয়াদিলি্লতে অবস্থানরত ফারুকুল ইসলাম মঙ্গলবার রাতে অনলাইন পত্রিকা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শ্যামল কান্তি ভক্ত ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রয়োজনে তাকে স্বপদে ফেরাতে তার কোনো আপত্তি নেই।

শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বরখাস্তের চিঠি পাওয়ার পরই অভিযোগ ওঠে, এমপি সেলিম ওসমানের নির্দেশেই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার সেলিম ওসমান সমকালের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেছিলেন, ‘বরখাস্তের সিদ্ধান্ত স্কুল পরিচালনা কমিটির।’ অবশ্য তিনি এও বলেন, ‘কমিটি শ্যামল কান্তির অপরাধ পেয়েছে।’

কয়েকজন অভিভাবক জানান, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০০২ সালের আগ থেকেই শ্যামল কান্তি ভক্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টির শুরু থেকেই পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে আছেন ফারুকুল ইসলাম। তারা বলেন, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন এবং শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করা নিয়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ কয়েকজন সদস্যের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বিরোধ চলে আসছিল।

বিদ্যালয়টিতে পড়েছেন এমন একাধিক ছাত্র  বলেন, ‘আমরা যখন বিদ্যালয়টিতে পড়েছি, কখনও শ্যামল স্যারকে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা কিংবা কটূক্তি করতে দেখিনি। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্যই তিনি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।’ এলাকাবাসী জানান, শুক্রবার স্কুল বন্ধ থাকার পরও পরিচালনা কমিটির জরুরি সভা হবে জানিয়ে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষককে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ে আসার পর তিনি উল্টো চিত্র দেখেন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরিচালনা কমিটির সভাপতির নির্দেশে স্কুলের প্রবেশ ফটকের সামনের মসজিদ থেকে ধর্মীয় উস্কানিমূলক ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর গ্রামের শত শত মানুষ বিদ্যালয় মাঠে অবস্থান নেন এবং শিক্ষকের বিচার দাবি করেন। এক পর্যায়ে গ্রামবাসী পরিচালনা কমিটির প্ররোচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধান শিক্ষককে মারধর করে।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী শ্যামল কান্তি ভক্তকে মারধরের ঘটনার পর উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে। এ বিষয়ে তাদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, শ্যামল কান্তির ঘটনাটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি পরিকল্পিত ঘটনার শিকার। অন্যায় সিদ্ধান্তকে মেনে না নেওয়া এবং সভাপতির বোনকে প্রধান শিক্ষক করতেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিচালনা কমিটির এক সদস্য সমকালকে বলেন, ‘কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামসহ একটি গ্রুপের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন প্রধান শিক্ষক। নিজের বোনকে প্রধান শিক্ষক বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সভাপতি। বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে কোনোভাবেই শ্যামল কান্তিকে চাকরিচ্যুত করতে না পেরে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় ধর্মীয় উস্কানির লেবাস লাগিয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়।’

তবে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য রাসেল জাহান সোহেল, সাবেক সদস্য ইখতিয়ার জাহানসহ কয়েকজন এমপির পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ‘এমপি সেলিম ওসমান ছিলেন বলেই ওই শিক্ষক প্রাণে বেঁচে গেছেন।’ কলাগাছিয়া ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা তাদের এ কথার সঙ্গে একমত নন। তারা বলেন, ওইদিন সেলিম ওসমান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস না করিয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। তিনি তা না করায় সারা জাতির কাছে বন্দর থানাকে কলঙ্কিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তার নির্দেশেই ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে।

১৩ মে শিক্ষক মারধরের ঘটনা ঘটলেও ১৬ মে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বরখাস্তের চিঠি পান প্রধান শিক্ষক। এ প্রসঙ্গে কল্যান্দী গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সভাপতি ১৪ মে থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৬ তারিখে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত করার চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন কে? অভিযোগ উঠেছে, পরিচালনা কমিটির একটি সিন্ডিকেট সভাপতির অবর্তমানে তার স্বাক্ষর জাল করে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্তের চিঠি দিয়েছে।

তবে বাংলা ট্রিবিউনকে বিষয়টি অস্বীকার করেন ফারুকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে ঘটনাস্থলেই তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দেন এমপি মহোদয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শিক্ষা কর্মকর্তা সে অনুযায়ী আমাদের ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন। আমরা ওইদিনই এ আদেশ পালন করি।’ আপনার স্বাক্ষরের নিচে তারিখ দেওয়া আছে ১৫ মে। এর আগেই আপনি দেশত্যাগ করেছেন। তাহলে ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন কবে?_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ওইদিনই ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছি। তবে তারিখ দিইনি। পরে কেউ তারিখটি বসিয়ে দিয়েছে। ফারুকুল ইসলামের ছোট বোন ওই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।

নারায়ণগঞ্জের খানপুর ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার তিন নম্বর কেবিনটি এখন গণমাধ্যম কর্মীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই কেবিনেই চিকিৎসাধীন লাঞ্ছনার শিকার শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত।

তিনি আক্ষেপ করে  বলেন, ‘প্রায় দুই যুগ পার করে দিলাম ওই স্কুলে। আমার অনেক শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল আমার জীবনের চেয়ে প্রিয়। যে এলাকার জনগণের সন্তানদের মানুষ করতেই ছিল ধ্যান-ধারণা। সেই গ্রামের মানুষের মিথ্যা অভিযোগে আমি পরিস্থিতির শিকার হয়েছি।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কিছু সদস্যের চক্রান্তের কারণে জীবিত থেকেও আমি এখন মৃত। জীবনের শেষ মুহূর্তে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও ওদের চক্রান্তের কাছে হার মেনেছে।’

ওইদিনের ঘটনার পর শ্যামল কান্তির চোখে ঘুম নেই, সময় কাটছে ভয় আর আতঙ্কে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে শ্যামল কান্তি  বলেন, ‘শুক্রবার ম্যানেজিং কমিটির সভা শুরুর ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই স্কুলের বাইরে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। একপর্যায়ে বাইরে থেকে আওয়াজ আসে_ ‘তোকে এখানেই মেরে ফেলব। তুই মরে যাবি, তোর লাশ পড়ে থাকবে। না হয় তুই রিজাইন দিয়ে চলে যাবি।’ তিনি ম্যানেজিং কমিটি বাতিল ও স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পারভীন আক্তারের অপসারণ দাবি করেন।

শ্যামল কান্তির স্ত্রী সাবিত্রী হালদার এই হাসপাতালের সিনিয়র নার্স। স্বামীর ওপর এমন ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন তিনি। স্বামীকে অপদস্থের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পর ভরসা পাচ্ছি_ দেশবাসী আমাদের সঙ্গে আছেন।’

হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. শফিউল আযম জানান, আগের চেয়ে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমরা বিষয়টি সার্বিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনে মেডিকেল বোর্ড বসিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। অপর এক চিকিৎসক বলেন, ওই শিক্ষক মানসিকভাবে বড় ধরনের আঘাত পেয়েছেন, অজান্তেই ভয় পাচ্ছেন। বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন সময় লাগবে।

শুক্রবার স্কুল পরিচালনা কমিটির সভা ডেকে মারধর ও জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমানের নির্দেশে ওই শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করিয়ে মাফ চাওয়ানোর ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষককে বরখাস্ত করায় আরও ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল এমপি সেলিম ওসমানসহ জড়িতের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *