আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য নীতিমালার আলোকে ২০১৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণ শ্রেণীকরণ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই বছরের বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। দুইয়ে মিলে ২০১৩ সাল শেষের ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ থেকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ও ব্যাংকগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুবিধা নিয়ে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়। এ ছাড়া বৈশ্বিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে বেকায়দায় পড়া বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে। এসব কারণে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা কমে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপি হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শনে কিছু ঋণ নতুন করে খেলাপি করে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসাইন বলেন, বিশেষ সুবিধায়
পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমায় অনেকে দাম বাড়ার আশায় ধরে রেখে যথাসময়ে ব্যাংকের টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর বাইরে শিপব্রেকিংসহ কিছু খাত সমস্যায় থাকায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে বছর শেষে এ পরিস্থিতি থাকবে না বলে তিনি মনে করেন।
এফবিসিসিআইর প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে দেশে জ্বালানি সরবরাহ ঠিক না থাকায় অনেকে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না, এতে জাহাজীকরণ হচ্ছে দেরিতে। ফলে ডিসকাউন্ট হচ্ছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ হিসাবে তিন মাসে মোট ঋণ বিতরণ ১৪ হাজার ৩৩ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৪০ শতাংশ বাড়লেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে আট হাজার ৪০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর। তিন মাসে এ খাতের খেলাপি ঋণ চার হাজার ৫৭১ কোটি টাকা বেড়ে ২৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে মোট ঋণের ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ খেলাপি ছিল, এখন তা বেড়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ঋণের ৭৫ দশমিক ৪০ শতাংশ এখন খেলাপি। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ন্যাশনাল, প্রাইম, সিটি ও উত্তরা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯ শতাংশের ওপরে। আর নতুন ৯টি ব্যাংকের মধ্যে অনিয়মের কারণে সর্বাধিক আলোচিত ফারমার্স ছাড়া বাকি আটটি ব্যাংকের কম-বেশি ঋণখেলাপি দেখানো হয়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আগের প্রান্তিকের এক হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা থেকে আরও কমে এক হাজার ৮২২ কোটি টাকায় নেমেছে।
বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সারোয়ার মনে করেন, মূলত তিনটি কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তিনি বলেন, রিয়েল এস্টেট খাত এখন ভালো যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমার কারণে চট্টগ্রামভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ আটকে আছে। আবার সংস্কারের কারণে ছোট ছোট অনেক গার্মেন্টস সমস্যায় পড়ায় সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে পারে।
তিন মাসে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা বেড়ে ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা হয়েছে, যা তাদের মোট ঋণের ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। আগের প্রান্তিক শেষে ২৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ ছিল খেলাপি। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতার খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আগের প্রান্তিকে যেখানে ব্যাংকটির দুই হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ছিল খেলাপি, এখন তা পাঁচ হাজার ৪১ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। আর নানা অনিয়মের কারণে আলোচনায় থাকা বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছয় হাজার ৩৯২ কোটি টাকা থেকে সামান্য বেড়ে ছয় হাজার ৮২৫ কোটি টাকা হয়েছে; যা মোট ঋণের ৫৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সোনালীর খেলাপি ঋণ আট হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে আট হাজার ২৭২ কোটি টাকা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ চার হাজার ২২৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে চার হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকে এখন খেলাপি ঋণ রয়েছে এক হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে যা এক হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা ছিল। আর বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৬৪৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৩৯ কোটি টাকা হয়েছে। আর বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে আগের প্রান্তিকের মতোই খেলাপি ঋণ রয়েছে চার হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়ে জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুস সালাম বলেন, শিথিল শর্তে পুনঃতফসিল করা কিছু ঋণের বিপরীতে পুরো ডাউনপেমেন্ট আদায় হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেসব ঋণ আবার খেলাপি করে দিয়েছে। তবে আগামী প্রান্তিকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশা করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে শ্রেণীকৃত ঋণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। এর মধ্যে মন্দমানে শ্রেণীকৃত ঋণকে উদ্বেগজনক মনে করা হয়। কেননা, এ ধরনের ঋণের আদায় হয় খুব কম। এ ছাড়া মন্দমানের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। মার্চ পর্যন্ত মোট শ্রেণীকৃত ঋণের মধ্যে মন্দমানে রয়েছে ৪৭ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। সন্দেহজনক মানে রয়েছে তিন হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। আর সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা নিম্নমানে রয়েছে আট হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা