এর আগে গত বছর খুলনা মহানগরীর শহীদ জিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের তিনটি কম্পিউটার নিজের বাড়িতে রাখার দায়ে প্রধান শিক্ষক বৈষ্ণব কুমার দাসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই বিদ্যালয়ে তিনটি কম্পিউটার সরবরাহ করে। কয়েক মাস পরেই প্রধান শিক্ষক এগুলো তার বাড়িতে নিয়ে যান। এতে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক কাজের জন্য কম্পিউটারগুলো নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেনি। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ধরা পড়ার পর প্রধান শিক্ষক বৈষ্ণব কুমার দাস তদন্ত কমিটিকে জানান, কম্পিউটারগুলো বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের বরখাস্তকৃত মেয়র বিএনপি নেতা মো. মনিরুজ্জামানের কাছে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয়ে নিরাপত্তা না থাকায় একটি তিনি তার বাসায় রেখেছেন। শিগগিরই তিনি এটি বিদ্যালয়ে নিয়ে যাবেন।
এভাবেই সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের শিক্ষা উপকরণ বেহাত হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কারণে এসব ক্লাসরুম তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশের ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে শ্রেণীকক্ষকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হিসেবে রূপ দেওয়া হয়। ওই শ্রেণীকক্ষে ল্যাপটপ, স্পিকার, ইন্টারনেট মডেম, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, স্ক্রিন সরবরাহ করা হয়। আর এতে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি সমন্বয়ের লক্ষ্যে ২০১২ সালের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিষ্ঠার পর এসব ক্লাসরুম এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় মনিটরিং আর পরিদর্শনের অভাবে এই শুভ উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয় মনিটরিং, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তদারকি এবং ভৌত অবকাঠামোর অভাবে শিক্ষার্থীরা মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষের পাঠদান সুবিধা পাচ্ছে না। আবার অনেক বিদ্যালয়ের প্রধান ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা উপকরণ নিজেদের বাসায় নিয়ে গিয়ে অনায়াসেই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তারা জানান, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে কোনো শিক্ষক কাজে ফাঁকি দিতে না পারেন কিংবা ব্যক্তিগত কাজে মাল্টিমিডিয়া উপকরণ ব্যবহার করতে না পারেন।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন বলেন, এসব ক্লাসের উপকরণ কমিটির সদস্যদের বাসায় ব্যবহৃত হওয়ার কিছু কিছু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এ কারণে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং, মেনটরিং, টেকসই করতে নতুন কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সারাদেশে মাউশির সব আঞ্চলিক উপপরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এসব নির্দেশনা দ্রুত জানিয়ে দেওয়া হবে। আশা করছি, এর পর মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা উপকরণ নিয়ে কোনো অভিযোগ শুনতে হবে না।
গত ২ মার্চ দেশের ১২৫টি উপজেলায় আইসিটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফর এডুকেশন প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের তাৎপর্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রূপান্তরে সরকারের নতুন পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
ভুল তথ্য দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান :মন্ত্রণালয় ও মাউশি সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমগুলোকে অনলাইনে ম্যানেজমেন্ট, মনিটরিং ও মেনটরিং করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের সহায়তায় ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে একটি অনলাইন ড্যাসবোর্ড তৈরি করা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস-সংক্রান্ত সব তথ্য সেখানে আপলোড করার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিদিন সারাদেশের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের চিত্র পর্যবেক্ষণ করতে চাইছেন এটুআইর কর্তারা। কোথাও কোনো ত্রুটি দেখা দিলে সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ারও সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠাতে বলা হয়েছে।
মাউশির উপপরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভল্যুয়েশন) এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, আগের চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। এটুআইর ড্যাসবোর্ড চালুর পর মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে। প্রধান শিক্ষকরা সেখানে তথ্য দিচ্ছেন। এরপরও কোথাও কোনো অভিযোগ পেলে তারা পরিদর্শনে ও তদন্তে যাচ্ছেন।
তবে তিনি এ কথা বললেও সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে কোনো ক্লাস না নিয়েই সরকারকে ভুল তথ্য দিচ্ছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবার অনেকে সপ্তাহে তিন দিন বা দু’দিন ক্লাস নিয়েই ছয় দিনের রিপোর্ট ড্যাসবোর্ডে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সমকালের দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমগুলোতে সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস হয় না। অথচ ছয় দিনই নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে মর্মে ড্যাসবোর্ডে অসত্য তথ্য দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেক বিদ্যালয়ে মোটেও কোনো ক্লাস হয় না। দৌলতপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের স্বীকারোক্তি মতে, উপজেলার তিনটি বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে কোনো ক্লাসই নেওয়া হয় না। এগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। এ বিদ্যালয়গুলো হলো_ মরিচা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইনসাফনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও চিলমারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা ক্লাস না নেওয়ার জন্য বিদ্যুতের সমস্যাকে দায়ী করেছেন।
মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন বলেন, ২৩ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়াগুলো অকেজো থাকতে পারে বলে তার ধারণা। তার বেশি হবে না। যারা অকারণে ক্লাসরুম বন্ধ করে রাখবে, তারা কঠোর শাস্তি পাবে। তিনি বলেন, আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাস প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার পর তারা নিজেদের উদ্যোগে উৎসাহী হয়ে আরও দু-তিনটি রুমকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পরিণত করেছে।
মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ১৩ হাজার ৩৩১টি প্রতিষ্ঠানের পর সরকার আরও ২৬ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে ক্লাসরুমকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ-সংক্রান্ত ডিপিপি এখন পরিকল্পনা কমিশনের বিবেচনাধীন।
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য :শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ কোনো প্রস্তুতিই যখন ছিল না, যখন কেউ ভাবতে পারেনি, তখনই আমরা সাহস করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছি। কিছু কম্পিউটার কিনে, কিছু ডোনেশনে এনে এ কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এলাকাবাসীও অনেক ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। এত প্রচেষ্টার ফসল বৃথা যাবে না। তিনি বলেন, আমরা চেয়েছি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও জানুক, কম্পিউটারকে চিনুক, তারা শিখুক। সেই অর্থে পূর্ণাঙ্গ সাপোর্ট হয়তো এখনও আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি না। তবে আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য ভবিষ্যতের অগ্রগতির পথ রচনা করা গেছে।
নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়ায় সারাদেশে ২৩ হাজারের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার মানসম্মত ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করা গেছে। কিছু আছে মোটামুটি। ঢাকা শহরে ১০০টি আন্তর্জাতিক মানের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লালবাগের একটি প্রতিষ্ঠান ফ্লোরজুড়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করেছে। এরপরও আমরা বলব না, সব কাজ করে ফেলেছি। যতটুকু ঘাটতি আছে, তা পূরণের চেষ্টা চলছে।