নারায়ণগঞ্জে কান ধরে ওঠবস করানোর পর এবার শ্যামল কান্তি ভক্তকে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ বরখাস্তের কথা বলেন।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে এখন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তারকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতির বোন।
প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত আজ মঙ্গলবার বরখাস্তের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি অসহায়। আমাকে যে অপমান-অপদস্থ করা হয়েছে, আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি চাই। আমাকে লাঞ্ছিতের পর এবার চাকরিচ্যুত করা হলো। হামলায় আহত হয়ে আমি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমার অসুস্থতাকে অনুপস্থিতি দেখিয়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি তিনটি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। আমার সবকিছু শেষ। আমার হারানোর কিছু নেই। আমার দেহে এখনো প্রাণ আছে, এটিই আমার জন্য যথেষ্ট।’
বরখাস্তের চিঠিতে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, আপনার (প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত) বিরুদ্ধে ছাত্রদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে অর্থ গ্রহণ, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য ও বিদ্যালয়ে ছুটি ব্যতিরেকে অনুপস্থিত থাকা এবং প্রায়ই দেরি করে বিদ্যালয়ে আসার আনীত অভিযোগ ম্যানেজিং কমিটির সভায় উত্থাপিত হয়। পূর্বেও এসব অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে এবং আপনাকে বহুবার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু আপনি এরূপ অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত হননি। তাই ১৩ মে ম্যানেজিং কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাকে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এই বরখাস্তের আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
বরখাস্তের চিঠির অনুলিপি স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, বন্দর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো হয়।
পরিচালনা কমিটির সভায় চাকরিচ্যুতির কারণ হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে অর্থ গ্রহণের যে অভিযোগ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে গত রোববার ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোবারক হোসেন গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আর্থিক কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই। তবে তিনি কারও কোনো কথা শুনতেন না। ম্যানেজিং কমিটির ওই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সভা শেষে করে ওই দিনই তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন। কিন্তু বরখাস্তের চিঠিতে তিনি কীভাবে ১৬ মে স্বাক্ষর করলেন—এ বিষয়ে আজ জানতে চাইলে মোবারক কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আ খ ম নুরুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির গতকাল সোমবার প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা জমা দিতে পারেনি। গত শুক্রবার প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আ খ ম নুরুল আলম।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শ্রেণিকক্ষে ‘ধর্মীয় কটূক্তির’ অভিযোগে গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় সাংসদ (জাতীয় পার্টি) এ কে এম সেলিম ওসমান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে মারধর ও কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা ঘটে। তবে প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
এ ঘটনার খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অবশ্য এ বিষয়ে সাংসদ সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের বলেছেন, থানার বিপুলসংখ্যক পুলিশ, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত লোকজনকে শান্ত করতে ব্যর্থ হন। পরে খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে উত্তেজিত জনরোষ থেকে প্রাণে রক্ষা করে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আর এলাকার লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষক স্বেচ্ছায় মাফ চেয়েছেন, কানে ধরেছেন।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এটি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। পুলিশ সেখানে গিয়েছিল, যাতে আমলযোগ্য অপরাধ না হয়।