ঢাকা: বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। সারাবছরের মধ্যে বৈশাখ-জৈষ্ঠেই বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, গত এক সপ্তাহে সারাদেশ বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। শনিবার একদিনে বজ্রাঘাতে মারা গেছে ৮ ব্যক্তি। একমাসে বজ্রপাতে প্রাণহানির এ সংখ্যা ৩৫। গত এক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে সারাদেশে নিহতের সংখ্যা ৮৫। এদের প্রায় ১১ শতাংশ শিশু।
বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের বজ্রপাতে মুত্যুর এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে।
এ পরিসংখ্যান জানতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীর দেয়া তথ্যমতে, বজ্রপাতে দেশে প্রতিবছর ৩০০ থেকে ৩৫০ মানুষের মৃত্যু হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়সহ সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ৫ বছরে দেশে বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ২৪৯। ওই হিসেবে বছরে গড়ে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ২৪৯ জন মানুষ। এছাড়া প্রতিবছর গড়ে বজ্রপাত হয় ১ হাজার ১৫৪ বার।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি ছিল। গড় তাপমাত্রা বাড়ায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায় ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আগামীতে বজ্রপাতের সংখ্যা আরো বাড়বে বলেও জানান তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিন তার ‘রিস্কফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলেছেন, প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়।
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, সঞ্চালনশীল গভীর মেঘমালার সংঘর্ষে বজ্রপাত হয়ে থাকে। বজ্রপাত বেশি হওয়ার সময় মূলত মে মাস। খোলা মাঠে যারা থাকেন তারাই এতে বেশি আক্রান্ত হন। তাই বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে না থাকার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে কথা না বলারও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। কারণ বজ্রপাত বন্ধ করা যাবে না কেবল সচেতন হলেই ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার কথা বলছেন তারা।
আবহাওয়া বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালে ৯৭৮, ২০১২ সালে ১ হাজার ২১০, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৪১৫, ২০১৪ সালে ৯৫১ এবং ২০১৫ সালে ১ হাজার ২১৮ বজ্রাঘাত হয়েছে। ৫ বছরে ৫ হাজার ৭৭২টি অর্থাৎ গড়ে ১ হাজার ১৫৪ বার করে বজ্রপাত হয়েছে।
অধিদপ্তরে দায়িত্বরত আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বাংলামেইলকে বলেন, কালবৈশাখী ঝড়ের সময় বজ্রপাত হয়। বিচ্ছিন্নভাবে সারা দেশেই এটা হয়। মূলত এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসে অধিকাংশ বজ্রপাত হয়ে থাকে। গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা অথাৎ মেঘের ভেতরে থাকা জলকণা ও বরফ কণার ঘর্ষণের ফলে এ বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ অতিমাত্রায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে এবং আগামীতে তা আরও বেড়ে যেতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ওই গবেষণায়।
গবেষণার ওই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ফোরাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭৯, ২০১২ সালে ৩০১, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১৪ সালে ২১০ ও গত বছর নিহতের সংখ্যা ছিল ২৭৪। আর চলতি বছরে এপ্রিলের মধ্যেই অন্তত ৫০ ব্যক্তির মৃত্যুর কথা বলছে সংস্থাটি।
আরেক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় কৃষক বা কৃষিজীবি মানুষ (প্রায় ৫১ শতাংশ)। এদের অধিকাংশই মাঠে কর্মরত অবস্থায় বজ্রপাতের শিকার হয়ে মারা যায়। এছাড়া বজ্রাঘাতে ১১ শতাংশ শিশুর মৃত্যু ঘটে। স্কুলে যাওয়া আসার পথেই মূলত শিশুরা এ ঘটনার শিকার হয়। ২২ শতাংশ মানুষ বজ্রপাতে মারা যায় ঘরে থাকা অবস্থাতেই। এছাড়া ১২ শতাংশ রাস্তাঘাটে এবং প্রায় ১৪ শতাংশ পানিতে থাকা অবস্থায় বজ্রাঘাতে মৃত্যুর শিকার হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, সম্প্রতি দেশে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আর খোলা জায়গাতেই বজ্রপাত বেশি ঘটতে দেখা যায়। আগে কৃষিতে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন মাঠে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেছে। ফলে মাঠে কাজ করা মানুষই বজ্রাঘাতের শিকার হচ্ছে বেশি।
আবহাওয়াবিদ শাহ আলম বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গ্রামের দিকে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। এটা বন্ধ করা যাবে না। প্রাকৃতিকভাবেই এটা হয়ে থাকে।