‘আমরা এক বিকৃত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিলতি করছি এবং আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের(সুজন) নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে সুজনের নেতৃবৃন্দ জানান, চলমান ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৭১ জন এবং আহত হয়েছেন ৬ শতাধিক। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সুজন আয়োজিত ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের হালচাল ও করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন। লিখিত বক্তব্যে সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, বিভিন্ন কারণে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে। কারণগুলোর মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি, মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপকতা, রেকর্ডসংখ্যক ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, একটি বড় রাজনৈতিক দল কর্তৃক অনেক ইউনিয়নে প্রার্থী দিতে না পারা, এক দলকেন্দ্রিক ফলাফল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হামলা-নির্যাতন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এক কথায় বলতে গেলে ব্যাপক অনিয়মের কারণে এই নির্বাচন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার ও রাজনৈতিকগুলোও, বিশেষ করে মতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দিলীপ কুমার সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সম্পর্কে বলেন, চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি ইতিমধ্যেই সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ইতিপূর্বে ১৯৮৮ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে চতুর্থ ধাপের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ও প্রত্যাহারের পর এই সংখ্যা ১৫০-এ দাঁড়িয়েছে। এরা সকলেই মতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী। অপরদিকে চার ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী শূন্য ছিল বা আছে মোট ৩৮৮টি ইউনিয়নে। অনেক স্থানে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধাদান, মনোনয়নপত্র কেড়ে নেয়া বা ছিঁড়ে ফেলার কারণে বিএনপি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। কেউ কেউ মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ভয়ভীতি প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টির কারণে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন। :
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি ধাপের নির্বাচনের পূর্বেই প্রতিপরে এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া বা ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া; বুথ দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরা; চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালটে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা; নির্বাচনী কর্মকর্তা কর্তৃক ব্যালট পেপারে সিল মারা বা সিল মারতে সহায়তা করা; ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কারণে তিন ধাপে মোট ১৩৯টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। কোনো কোনো ইউনিয়নে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ারও অভিযোগ উঠেছে। :
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা বিকৃত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ল করছি। নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়মের পাশাপাশি বর্তমানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অশনিসঙ্কেত। তিনি বলেন, শুধু নির্বাচনের দিনকে বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বললে হবে না, বরং নির্বাচনের আগে-পরে কী ঘটছে, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে কিনা এবং সবাই প্রার্থী হতে পারছে কিনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। : সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। তাই ভবিষ্যতে দলভিত্তিক নির্বাচন করা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে গণমাধ্যমে জোরালো আওয়াজ তোলা দরকার। কারণ আমাদের দলগুলো এখনও দলভিত্তিক নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, শুধু আইন ও মতা থাকলেই নির্বাচন কমিশনের পে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ কারা কমিশনে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সদিচ্ছা ও সাহস নিয়ে কাজ করছেন কি না সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
সভাপতির বক্তব্যে এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যান পদে প্রায় ১৫০ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটেছে। এর মাধ্যমে খারাপ নির্বাচনের একটি ট্রেন্ড বা নজির সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মনোনয়ন বাণিজ্য রোধে দলীয় প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। : :