গ্রাম বাংলা ডেস্ক: রাজধানীর রাজাবাজারে নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হলেন হাইকোর্ট মাজার মসজিদের খতিব ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক মাওলানা শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী। তার খুনের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে পুরো দেশ। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ফারুকীর হত্যার প্রতিবাদে আগামী রোববার সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ইসলামী ছাত্রসেনা। খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আল্টিমেটামসহ নানা কর্মসূচি দিয়েছে বিভিন্ন ইসলামী দল। বিভিন্ন দলের ব্যানারে গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। মাওলানা ফারুকীর খুনের ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি খুনিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ফারুকীর খুনিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে তার ছেলে। মামলায় অজ্ঞাত ৭/৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর পরই পুলিশ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ৩ জনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ফারুকীর হত্যাকা-ে জড়িত খুনিদের শিগগিরই খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
মাওলানা ফারুকীর খুনের ঘটনায় গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ব্যানারে সকল সুন্নি সংগঠন, দরবার খানকা এবং ইসলামী সংগঠন সকাল থেকে বাদ আসর পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। প্রতিবাদ সামবেশ শেষে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। মিছিলটি পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলা হয়ে বায়তুল মোকাররম উত্তরগেট হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে মিলাদ-কিয়াম এবং শহীদ ফারুকীর রুহের মাগফরাত কামনায় দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। গণমিছিল পূর্ব সমাবেশে শহীদ ফারুকীর হত্যার প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ (শুক্রবার) বাদ জুমা সকল মসজিদে দোয়া মাহফিল এবং বাদ জুমা ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে মরহুমের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। এতে ইমামতি করবেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমের খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহ উদ্দিন। জুমার নামাজ শেষে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া আগামী ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ এবং শনিবার ঢাকার বায়তুল মোকারম সম্মেলন হলে তার স্মরণে আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ইসলামী ছাত্রসেনা আগামী রোববার সারাদেশে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সমাবেশ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের আলটিমেটাম দেয়া হয়। অন্যথায় পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়। সমাবেশে পীর-মাশায়েক, ওলামায়ে কেরাম বলেন, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যার পরিকল্পনাকারী তারেক মনোয়ার, মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী এবং মুফতি ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করলে সম্প্রতি টঙ্গিতে গোপন বৈঠক করে হত্যার পরিকল্পনার বিষয় উদ্ঘাটিত হবে।
ফারুকীর খুনিরা পেশাদার
মাওলানা ফারুকী খুনের কয়েক ঘণ্টা পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য বুধবার রাত পৌনে ২টায় নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। সেখানে গতকাল বেলা সোয়া ২টায় নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত শুরু হয়। আধা ঘণ্টা পর লাশের ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. হোসেন বলেন, খুনের ধরন দেখে স্পষ্টই বলা যায় এটা পেশাদার খুনিদের কাজ। গলায় ৫ ইঞ্চি লম্বা এবং দেড় ইঞ্চি গভীরতার ছুরিকাঘাত দেখা যায়। তিনি আরো বলেন, প্রফেশনাল কিলার না হলে একজন সুস্থ ও সুঠাম দেহের পুরুষকে এভাবে খুন করা যায় না। হাসপাতাল মর্গে নিহতের মামা শফিকুর রহমান জানান, ইসলামের নামে অপপ্রচারকারী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই খুন হয়েছেন ফারুকী। এদিকে শাইখ নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকান্ডে গোপীবাগ ‘সিক্স মার্ডারের’ ছায়া দেখছে পুলিশ। গোপীবাগ এবং খুলনার খালিশপুরের পিতা-পুত্র হত্যাকান্ডে খুনিদের ব্যবহৃত অস্ত্র, খুনের ধরন এবং খুনিদের আচরণের সাথে রাজাবাজারে ফারুকী হত্যার অনেকগুলো মিল খুঁজে পেয়েছে গোয়েন্দারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্তি উপ-কমিশনার আশিকুর রহমান বলেন, গোপীবাগের হত্যার রহস্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে রাজাবাজারের হত্যার ঘটনার মিল পাওয়া যাচ্ছে। বাসায় ঢুকে, বাসার লোকজনের সাথে আলাপচারিতা এবং হাত-পা বাঁধার কৌশলও এক। বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘গোপীবাগের ৬ জনকে গলা কাটার স্থান, ধারালো ছুরি, বাসার সবাইকে বেঁধে রাখা, মুখে স্কচটেপ ও রশি-সবক্ষেত্রেই মিল পাচ্ছি আমরা।’ এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘ফারুকীর খুনিরা খুনের সময় সাথে কোনো মোবাইল ফোন আনেনি। ডিবি পুলিশের কল ট্র্যাকিং সম্পর্কে ধারণা আছে তাদের। ফলে আমরা ধরে নিচ্ছি খুনিরা পেশাদার। গোপীবাগের ৬ খুনের ঘটনায় খুনিরা মুরিদ সেজে বাসায় ঢোকে। একই ঘটনা ঘটেছে ফারুকী হত্যাকান্ডে। খুনিরা হজযাত্রী সেজে তার বাসায় ঢোকে। গোপীবাগ ৬ খুনের ঘটনায় কথিত মুরিদরা পীর লুৎফর রহমানের সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করে একসাথে মুড়ি খায়। ফারুকী হত্যাকান্ডেও খুনিরা ঠান্ডে মাথায় বাসায় ঢুকে ফারুকীর সাথে ড্রয়িং রুমে আলাপ-আলোচনা করে এবং আরো লোক আসার কথা বলে কালক্ষেপণ করে। এক পর্যায়ে তাকে খুন করে পালিয়ে যায়। খুনিরা বাসার লোকজনকে বাধার উদ্দেশে নিজেদের ব্যাগে করে গামছা ও কাপড় নিয়ে আসে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ধর্মীয় মতবিরোধ থেকে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে আগের আরো চারটি হত্যাকা-ের মিল রয়েছে। এ সব হত্যাকান্ডেই হত্যাকারীদের সঙ্গে নিহত ব্যক্তির যোগসূত্রতা ছিল। তারা একই কায়দায় এসব বাসায় যাতায়াত করতেন। একই স্টাইলে হত্যার আগে বাসায় প্রবেশ করে অন্যান্য বাসিন্দাদের অন্য রুমে আটকে রেখে কাপড়-চোপড় দিয়ে হাত-পা বেঁধে গলা কেটে (জবাই) ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। গত বুধবার রাতে ৭/৮ জন দুর্বৃত্ত পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় হাত-পা বেঁধে গলা কেটে তাকে হত্যা করে।
জানাজা অনুষ্ঠিত
গতকাল তার প্রথম জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয় চ্যানেল আইয়ের প্রাঙ্গণে। এর পর পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে মরহুমের দ্বিতীয় জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এর পর লাশ রাখা হয় বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে। আজ বাদ জু’মা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তার তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠি হবে। নিহতের প্রবাসী ছেলে দেশে ফেরার পরই লাশ পঞ্চগড়ে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানায়।
থানায় মামলা : ৩ জন আটক
শেরে বাংলানগর থানার ওসি আবদুল মোমিন জানান, বুধবার গভীর রাতে ফারুকী হত্যার ঘটনায় নিহতের মেঝ ছেলে ফয়সাল ফারুকী অজ্ঞাত ৭/৮ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, বুধবার রাতে ডাকাতি করতে এসে পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে তিন ‘প্রত্যক্ষদর্শীকে’ থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আটককৃতরা হলেন, রফিকুল ইসলাম, মো. শফিক ও মো. বেলাল।
মাওলানা ফারুকীর জীবনী
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী ১৯৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর পঞ্চগড় জেলার বড়শশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে এক মাওলানা জামসেদ আলীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দুই স্ত্রী। ঘটনার দিন তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে রাজবাজারের নিজ বাসায় ছিলেন।
নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন ফারুকী। নীলফামারীর ডোমার তিনিহাটি জামেউল উলুম সিনিয়র মাদরাসা থেকে ১৯৭৫ সালে দাখিল পরবর্তীতে আলিম পাস করেন। ১৯৭৯ সালে প্রাচীনতম ঐতিহাসিক ছারছিনা দারুল সুন্নাত আলীয়া মাদরাসা (বরিশাল) থেকে কামিল (হাদিস বিভাগ) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮১ সালে নীলফামরী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে জগন্নাথ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে করেন। ১৯৮৯ সালে প্রথম হজের উদ্দেশে মক্কায় যান তিনি। ওই বছর জেদ্দা বিমানবন্দর মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পান ফারুকী। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফেরত আসেন। এসময় ঢাকাসহ বিভিন্ন মসজিদে ৩৩ বছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন আলীয়া মাদরাসায় ১৫ বছর শিক্ষকতা, রেডিও, টেলিভিশনে ২৫ বছর ওয়াজ নসিয়তে অনুষ্ঠান করেন।
তার উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে কাফেলার জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। এ অনুষ্ঠানটির জন্য তিনি মুসলিম বিশ্বের ১০টি দেশে ভ্রমণ করেন। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষের সুন্দর ও সঠিক নিয়মে পবিত্র হজ পালনে ২৫ বছর হজ কার্যক্রম চালিয়েছেন।
মাওলানা ফারুকী মক্কা মোয়াজ্জামায় আলামা সায়েদ মোহাম্মদ মালিকি আলাদি (রা.) রওজায় ১০ বছর দায়িত্ব প্রালন করেন। এছাড়া ছারছিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহর মাজারে খেদমত করেন। শেষ জীবনে খাজা হযরত শরফুদ্দিন চিশতির মাজারে খাদেম ও সুপ্রিমকোর্ট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি। তার বইগুলো সুফিবাদভিত্তিক। সর্বশেষে ‘মারেফুল হারামাইন’ বইটি লিখেছেন। বইগুলোতে ইসলামের আদি বা অবিক্রীত রূপগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বলে তার ভক্তরা জানিয়েছেন। মাওলানা ফারুকী সংসার জীবনে দুই বিয়ে করেন। তার দুই সংসারে ২ মেয়ে ৪ ছেলে রয়েছেন। ছেলেরা হলেন, মাসুদুর ফারুকী, আহমেদ রেজা ফারুকী, ফয়সাল ফারুকী, মো. ফুয়াদ ফারুকী। মেয়েরা হলেন, হুমায়রা তাবাচ্ছুম তুবা, লাবিবা লুবা। এদের মধ্যে মাসুদ এবং দুই মেয়ে প্রথম সংসারের। তার প্রথম স্ত্রী রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় থাকেন বলে জানা গেছে। মাওলানা ফারুকী ইসলামী মিডিয়া জনকল্যাণ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদের সেক্রেটারিও ছিলেন তিনি। এছাড়া মেঘনা ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মাওলানা ফারুকী।
সূত্র ইনকিলাব