ফায়ার সার্ভিস কতটা প্রস্তুত

Slider জাতীয়
untitled-1_209802
ঘটনাস্থল কারওয়ান বাজারের হাসিনা মার্কেট। আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে গত রোববার সেখানে ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গিয়ে দেখেন, লেলিহান আগুন নেভানোর মতো পানি নেই সেখানে। পাশের একটি মসজিদ ও লা ভিঞ্চি হোটেলের রিজার্ভ ট্যাঙ্ক থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন তারা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব পানিবাহী ১২টি গাড়ি। আগুন লাগার পর এমন পানি সংকটের মুখোমুখি প্রায়ই হতে হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। কারণ, অধিকাংশ ভবন ও মার্কেটেই পানির রিজার্ভ ট্যাঙ্ক নেই। তাদের নির্ভর করতে হয় আশপাশের ভবন ও ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ির ওপর। ভূমিকম্প, অগি্নকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনাস্থলে পেঁৗছাতেও অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় তাদের।

অপ্রশস্ত পথঘাট ছাড়াও যানজটসহ নানা অব্যবস্থাপনা এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। উন্নত বিশ্বে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও আট মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পেঁৗছানোর প্রস্তুতি থাকে ফায়ার সার্ভিসের। আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে ঘটনাস্থলে পেঁৗছাতেই হিমশিম খেতে হয়। প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম ও জনবল সংকট তো রয়েছেই। ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিসে অন্তত ১৫ হাজার রিজার্ভ জনবল দরকার। প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলের কার্যালয়ের আওতায় অগি্ননির্বাপণের কিছু যন্ত্রপাতিও থাকা জরুরি। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভিশন অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে সংস্থাটির অগি্নকাণ্ডসহ সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

বর্তমানে রাজধানীতে ১৪টি ও সারাদেশে ৩১০টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। সংস্থাটির দাবি, যানজট না থাকলে ঢাকায় কোনো দুর্ঘটনাস্থলে সাত-আট মিনিটের মধ্যে যাওয়ার মতো প্রস্তুতি ফায়ার সার্ভিসের রয়েছে। তা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলায় এরই মধ্যে সারাদেশে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারা।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও তত্ত্বাবধান) মেজর শাকিল নেওয়াজ  বলেন, ‘যে কোনো দুর্ঘটনার পর অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিও দেখা দেয়, যেমন- দুর্ঘটনাস্থলে শত শত উৎসুক মানুষ ভিড় করে। এতে অগি্ননির্বাপণের জরুরি কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তবে কেউ কেউ আবার সাহায্যও করেন। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে।’

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মোজাম্মেল হক  বলেন, ‘যে কোনো ভবন ও মার্কেট তৈরির আগে সেখানে পানির সোর্স রাখা বাধ্যতামূলক। এমনকি সুউচ্চ ভবনের প্রতিটি তলায় নিজস্ব অগি্ননির্বাপণ যন্ত্রপাতি থাকা উচিত। অগি্ননির্বাপণের আধুনিক ধারণার সঙ্গে কিন্তু উঁচু মইয়ের ধারণা মানানসই নয়। কারণ, তা তৈরি বা বহন ও ব্যবহার করা সম্ভব নয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ উঁচু মইয়ের দৈর্ঘ্য ১৫৫ ফুট। সেটি আমাদের ফায়ার সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে। উন্নত দেশে উঁচু ভবনের প্রতিটি তলায় এমন অগি্ননির্বাপণ যন্ত্রপাতি থাকে, যা ব্যবহার করে প্রথমে আগুনের বিস্তৃতি মোকাবেলা করা হয়।’

সংস্থার নানা সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা :তবে আগুন নেভানো ও দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় উদ্ধারকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে আধুনিক যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের। জনবল যা আছে, তা-ও পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে বড় সমস্যা অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অগি্ননির্বাপক সনদ ছাড়াই ভবন নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় জলাধার না থাকা। তাই বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগার পর সংস্থাটি তা নেভানোর চেষ্টা করলেও বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে না যাওয়া, নেভানোর সময় পানি শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

ফায়ার সার্ভিসে বর্তমানে নিজস্ব পানির জলাধারের (রিভার ব্যাংক স্টেশন) কম। সম্প্রতি উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি পানিবাহী গাড়ি যুক্ত হলেও তা অপ্রতুল। বহুতল ভবনে আটকেপড়াদের উদ্ধার করতে টার্ন টেবিল ল্যাডারও তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম। রাস্তার পাশে, খাল বা নদীসহ বিভিন্ন খাদে পড়ে যাওয়া কোনো যানবাহন উদ্ধারের যন্ত্র ব্রেকডাউন ভ্যানও প্রয়োজনের চেয়ে কম।

সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করলেও ব্যর্থতার কথা মানতে রাজি নন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, খবর পাওয়ার সর্বোচ্চ এক মিনিটের মধ্যে অগি্ননির্বাপক দল ঘটনাস্থলের উদ্দেশে স্টেশন ত্যাগ করে। তাদের মতে, ঘটনাস্থলে দেরিতে পেঁৗছানোর কারণ যানজট ও সরু রাস্তা। আগুন নেভাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা পানির অভাব। ভবন মালিকরা নিয়ম মেনে জলাধার তৈরি করেন না। গাড়ির রিজার্ভ পানি দ্রুত শেষ হয়ে গেলে আবার পানি সংগ্রহ করে আগুন নেভানো সময়সাপেক্ষ।

সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রম: সংস্থাটিতে বর্তমানে সাত হাজার অপারেশনাল ফোর্স রয়েছে। এ ছাড়া সারাদেশে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেছে সংস্থাটি। আরও কয়েকটি বেসরকারি এনজিওর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারা। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলছেন, অনেক সংকটের পরও তাদের কর্মীরা থেমে নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সব সময়ই দ্রুততম কম সময়ের মধ্যে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। অপারেশনাল কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। বর্তমানে কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৮ কোটি টাকার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম কেনার কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া চীন সরকারের অনুদানে কয়েক কোটি টাকার অগি্ননির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সার্ভিসে ২২ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্পেশাল ওয়াটার টেন্ডার, ১২ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফোম টেন্ডার, ১০০টি টোয়িং ভেহিক্যাল, ১৫০টি টু-হুইলার ওয়াটার মিস্ট ও বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স যুক্ত হয়েছে। এসব অগি্ননির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জাম শতভাগ সেবাদানকারী এ সংস্থাকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছে।

ফায়ার সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে দুই হাজারের বেশি অগি্নকাণ্ড মোকাবেলা করতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। এতে অন্তত ৩০ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আগুন নিভিয়ে সম্পদ রক্ষার পরিমাণ এর চার গুণের বেশি।

এদিকে, আগুন নেভাতে গিয়ে সংস্থার কর্মীদের অভিজ্ঞতা, বেশির ভাগ ভবন বা বহুতল ভবন নকশা মেনে তৈরি হয়নি। অগি্ননির্বাপক সরঞ্জামও নেই। আগুন লাগার অন্যতম কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। অগি্নপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩-এর ৭ ধারা অনুযায়ী অগি্ননির্বাপণ ছাড়পত্র ছাড়াই তৈরি হয়েছে অনেক বহুতল ভবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *