পঙ্গু ভিক্ষুকদের রাস্তায় বসিয়ে আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে(এসি) বসে অপেক্ষা করি কখন ভিক্ষার টাকা আসবে। অনেক মানুষ আছেন যারা রিক্সায় উঠে নানা জায়গায় যান। রাস্তায় রিক্সা ওয়ালার নিকট থেকে টাকা নিয়ে চা সিগারেট খান। কিছুুক্ষন পর কোথাও রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখে কেটে পড়েন। আর তখন রিক্সাওয়ালা ওই যাত্রী বা যাত্রীদের বকাবকি করতে করতে চলতে থাকেন। সমাজের কিছু শ্রেনীর মানুষ আছেন যারা শ্রমিক দিয়ে কাজ করান অথচ টাকা দিতে গিয়ে কৃপনতা করেন। অনেকে কাজ শেষে টাকা না দিয়ে শ্রমিকদের তাড়িয়ে দেন। অনেক হতভাগা শ্রমিক আছেন যারা কাজ শেষে টাকা চাইতে গিয়ে মালিকের হাতে নিহতও হয়েছেন।
আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শ্রমের মূল্য ও মর্যাদা কম। আমরা শ্রম নির্ভর দেশের মানুষ। অথচ রাষ্ট্রের মুলনীতিতে শ্রমের বিশদ কোন বর্ননা ও মূল্যায়ন নেই। তবে শুধু অধিকারের কথা বলা আছে। যে অধিকার সকল নাগরিকেরও। আমরা কোন সময় শ্রমের আলাদা কোন মূল্যায়ন করি না। আমরা জেনেও না জানার ভান করি তা নয় আসল কথা হল আমরা শ্রমকে গুরুত্ব দেই শ্রমিককে নয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন নেই। ফলে সারা বছরই শ্রমিকেরা শ্রমের মূল্য পেতে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। অনেক সময় রাস্তা ঘাটে ঝামেলা এড়াতে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে গুলিও বর্ষন করি। যার শ্রমে আমার বিলাসবহুল জীবন তার শ্রমের মজুরী চাওয়ার অপরাধে তাদের মেরে ফেলি।
আমরা অন্যকে দিয়ে কাজ করাই। নিজেরা করি না। অন্যের শ্রমের বিনিময়ে আমরা রাজ্য পরিচালনা করি কিন্তু শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করি না। শ্রমিকদের মজুরী দিতে গিয়ে আমরা কৃপনতা করি। কখনো কখনো শ্রমের মজুরীর দাবিতে শ্রমিককে রাজপথে খুনও হতে হয়। তাই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানদন্ডে শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। মহান মে দিবসে এই হউক আমাদের অঙ্গীকার।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কল-কারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে ১৬ ঘণ্টা প্রতিদিন কাজ করতে হতো। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে শ্রমিকের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। তখন দাবি উঠেছিল, কল-কারখানায় শ্রমিকের গোটা জীবন কিনে নেয়া যাবে না। এই দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রায় ৩ লাখ মেহনতি মানুষ ওই সমাবেশে অংশ নেয়। একপর্যায়ে আন্দোলনরত ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের রুখতে মিছিলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে পুলিশের গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হন। পরে আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় গ্রেপ্তারকৃত ৬ শ্রমিককে। কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিক নেতা আত্মহননও করেন। পরের বছর প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়। পালন করা হয় ব্যাপক কর্মসূচি।
দিনটি উপলক্ষে আজ সরকারী- বেসরকারী সকল অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে বন্ধ থাকবে সংবাদপত্র অফিসও। এছাড়া মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আজ সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র, নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। বেতারসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার হচ্ছে। দিনটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছন।
পরিশেষে দাবি রইল, আমরা যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করি বা শ্রম নির্ভর জীবন যাপন করি তারা যেন শ্রম নির্ভর এই বাংলাদেশে শ্রমিকের যাথাযথ মর্যাদা দেই। শুধু বছরের একটি দিনে সংস্কৃতিগত প্রথাকে যিঁইয়ে রাখতে ও নিজেদের বাহাদুরী প্রদর্শন করতে সকল জায়গায় চিৎকার চেঁচামেচি করে আন্তর্জাতিক মে দিবস পালন না করি। মে দিবসের তাৎপর্য আমাদের হুদয়কে নতুন করে জাগিয়ে তুলবে আর নব উদ্যামে পালিত হবে মহান মে দিবস। যে দিবসে শ্রমের মজুরীর জন্য থাকবে না শ্রমিকের আর্তচিৎকার। রাজপথে রাঙিবে না শ্রমিকের রক্তে। এই প্রত্যাশা রইল।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম