যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হামলাগুলোর পেছনে দায়ী চরমপন্থি গ্রুপগুলো। মধ্যপন্থি বাংলাদেশে চরমপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটি। মার্কিন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার এসব হামলায় রাজনৈতিক বিরোধীদের দায়ী করলেও, প্রাপ্ত প্রমাণাদি নির্দেশ করে যে, হামলার জন্য চরমপন্থি গ্রুপগুলোই দায়ী। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে আইএস’র শেকড় গেড়ে বসার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে ‘এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি’ বিষয়ক এক শুনানিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন ব্লিঙ্কেন।
এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি। খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে ইউএসএইডের এক কর্মী হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত এ দেশটির ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য আছে। তবে বাংলাদেশ বর্তমানে চরমপন্থিদের হুমকিতে রয়েছে।
লেখক, ব্লগার, বিদেশী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক প্রাণঘাতী হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক জিহাদী গোষ্ঠীগুলো রয়েছে বলে স্বীকার করে না বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ইউএসএইড’র কর্মী ও সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নানকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদা অন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের বাংলাদেশ শাখা। এ দায় সমপর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কিন্তু এসব ঘটনা ভীতি বাড়াচ্ছে যে, স্থানীয় চরমপন্থিরা বাংলাদেশে আল-কায়েদা বা আইএস’র মতো গোষ্ঠীগুলোকে অবস্থান পাকাপোক্ত করার সুযোগ করে দিতে পারে। যে দেশটি এমনিতেই শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যকার তিক্ত বিভক্তির কারণে সৃষ্ট দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিধ্বস্ত।
শুনানিতে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেন রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবোট। তিনি তার প্রশ্নে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হন। আর নির্বাচন বর্জন করেন খালেদা জিয়া ও তার দল। ফলে আমার মনে হয় দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা অনিশ্চিত। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশ মধ্যপন্থি মুসলিম দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি সহিংস কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সপ্তাহেই সমকামী অধিকার কর্মী এবং ইংরেজি বিষয়ের একজন অধ্যাপককে জনসমক্ষে হত্যা করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উগ্রপন্থি গ্রুপগুলো সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়ে কি করা যেতে পারে তা নিয়ে ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের মন্তব্য জানতে চান শ্যাবোট। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় শীর্ষ কূটনীতিক ব্লিঙ্কেন বলেন, যদিও সরকার এসব হামলার জন্য রাজনৈতিক বিরোধীদের দায়ী করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণাদি নির্দেশ করছে যে, এসব হামলার জন্য চরমপন্থি গ্রুপগুলো দায়ী। এরা হতে পারে স্থানীয় কিংবা আইএস/আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, ‘এসব ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে আইএস’র শেকড় গেড়ে বসতে পারার সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোনোভাবেই এটা আমরা চাই না।’
সংখ্যালঘু ও মধ্যপন্থিদের ওপর হামলা, যা সাধারণত চালিয়ে আসছে ছুরি বা চাপাতিধারী তরুণরা, তা শুরু হয় ২০১৩ সালে। এরপর থেকে এসবের বিস্তার কেবল বেড়েছে। হতাহতদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি-আমেরিকান লেখক অভিজিৎ রায়। তাকে ঢাকার একটি সড়কে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করা হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে যে, অন্যরাও জঙ্গিদের হত্যার হুমকিতে আছে। কারণ, সরকার তাদের দুর্দশা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। কারণ, সরকার হয়তো কিছু ব্লগারের নাস্তিক্যবাদী লেখালেখিতে ক্ষুদ্ধ মুসলিমদের সমর্থন হারাতে চায় না। কর্তৃপক্ষ কিছু মামলায় কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে। কিন্তু এদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ এখনও মূলহোতাদের চিহ্নিত করতে পারেনি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ঝুঁকিতে থাকা কয়েকজন ব্যক্তিকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। তবে, এখনও সপষ্ট নয় যে, এটি আদৌ করা হবে কিনা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত ডিসেম্বর থেকে এ আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ওয়াশিংটনের জন্য আরও বড় উদ্বেগ হলো, ধর্মীয় চরমপন্থিদের জন্য বাংলাদেশ উর্বরক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তমতের ঐতিহ্য; খ্রিস্টান ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাস ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে সফলতা রয়েছে। ওয়াশিংটন বিশ্বব্যাপী আইএস জঙ্গিদের মোকাবিলায় হিমসিম খাচ্ছে।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশন নামে মার্কিন একটি থিঙ্কট্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিসা কার্টিস বলেন, ‘বাংলাদেশ সবসময় এমন একটি দেশ ছিল, যেটিকে আমরা একটি আদর্শ মুসলিম গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে তুলে ধরেছি। এখন মনে হচ্ছে, সে জায়গা থেকে ক্রমেই পিছু হটছে দেশটি।’ তিনি বর্তমান হত্যাযজ্ঞকে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশি সমাজের স্বাভাবিক রূপকে পালটে দেয়া বা একে ইসলামীকরণ করার চেষ্টা হিসেবে।
ফেব্রুয়ারিতে, কংগ্রেসের এক সাক্ষাতে মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্সের পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের হুমকি সমপর্কে কথা বলেন। তখন তিনি বাংলাদেশ সমপর্কে বিরল এক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিরোধীদের দুর্বল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টা আসলে ‘দেশটিতে নিজেদের উপস্থিতি বিস্তার করতে আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করে দেবে।’
দেশের আধিপত্যবিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত হয়েছেন হাসিনা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ক্রমেই কোণঠাসা করেছেন। এ দলটি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন বয়কট করেছিল। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেন। এতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী দলের কয়েকজন নেতার মৃত্যুদণ্ড হয়। এ দলটি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়।
বিরোধী দলগুলো সামপ্রতিক এসব হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, নিরাপত্তা ব্যর্থতা ঢাকতে তাদের বলির পাঁঠা বানাচ্ছে সরকার। মান্নান হত্যার জন্যও বিরোধীদের দায়ী করেছেন হাসিনা। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরই, আল-কায়েদা অন দ্য ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের সহযোগী আনসার-আল-ইসলাম জানায়, তারাই ওই অ্যাক্টিভিস্ট ও তার অভিনেতা বন্ধুকে হত্যা করেছে। কারণ হিসেবে এ গ্রুপটি বলেছে যে, তারা ছিল বাংলাদেশে সমকামিতার প্রচারণা ও চর্চার অগ্রদূত।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, কাউন্টার-টেরোরিজম ও গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানে বাংলাদেশকে তারা ভালোভাবে সহায়তা করছেন। তারা এ-ও বলেন, বাংলাদেশ আন্তঃদেশীয় জিহাদী গ্রুপগুলোর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও, সামপ্রতিক কয়েক মাসে মার্কিন ও বাংলাদশি কর্মকর্তারা এসব নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। এসব বৈঠকে দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর গেড়ে বসার ঝুঁকি কমানো নিয়ে আলোচনা হয়। তবে আল-কায়েদা ও আইএস উভয়েই পরিষ্কার করে জানান দিয়েছে তারা বাংলাদেশে অবস্থান পোক্ত করতে চায়।
২০১৪ সালে, আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি বাংলাদেশে জিহাদের আহ্বান জানান। আইএস’র অনলাইন ম্যাগাজিন দাবিকের কয়েকটি সামপ্রতিক নিবন্ধের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশ।
দাবিকের এ মাসের সংস্করণে বাংলাদেশে আইএস’র কথিত এক নেতার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তার নাম বলা হয়েছে শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। আল-হানিফ সাক্ষাৎকারে বলেন, বৈশ্বিক জিহাদের জন্য বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান রয়েছে। সে জানায়, বাংলাদেশে একটি শক্ত ঘাঁটি থাকলে ভারতের অভ্যন্তরে গেরিলা হামলা চালানো সহজ হবে। এটি মিয়ানমারে জিহাদ পরিচালনা শুরু করতেও সহায়ক হবে।